ক্ষণা খুব বেজার মুখ করে বলল, কাজের লোকদের যে কেন বিয়ে করা। সপ্তাহে একটা মাত্র ছুটির দিন তাও তোমার ফি রবিবার মিটিং।
সুবিনয়ের দামি রেজারে যখন দাড়ি কামাচ্ছিলাম তখন নার্ভাসনেসের দরুন দু জায়গায় গাল কেটে গেল।
শুনলাম ঘরে ক্ষণা সুবিনয়কে বলছে, তোমার সেফটি রেজার উপলবাবুকে ইউজ করতে দিলে কেন?
তাতে কী? খুব উদার স্বরে সুবিনয় বলল, উপলের কোনও ডিজিজ নেই। তা ছাড়া ও আমার ভীষণ রেভিয়ারড ফ্রেন্ড। জানো না তো স্কুল কলেজে ও কী সাংঘাতিক ব্রিলিয়ান্ট ছেলে ছিল। এ জিনিয়াস ইন ডিসগাইজ।
ক্ষণা বিরক্ত হয়ে বলল, কে কী ছিল তা জেনে কী হবে। এখন কে কীরকম সেইটেই বিচার করা উচিত। আর কখনও তোমার সেফটি রেজার ওকে দিয়ো না।
সুবিনয় খুব ব্যগ্র গলায় বলে, এ রকম বলতে নেই ক্ষণা। উপল একটু চেষ্টা করলেই মস্ত আর্টিস্ট হতে পারত, কিংবা খুব বড় গায়ক কিংবা শিশির ভাদুড়ির মতো অভিনেতা। ও যে সিনেমায় নেমেছিল তা জানো? তারপর ফিল্ম লাইনে ওকে নিয়ে টানাটানি। কিন্তু চিরকালের বোহেমিয়ান বলে ও বাঁধা জীবনে থাকতে রাজি হল না। এখনও ইচ্ছে করলে ও কত কী করতে পারে।
দাড়ি কামানোর পর আমি জীবনে এই প্রথম সুবিনয়ের দামি আফটারশেভ লোশন গালে লাগানোর সুযোগ পেলাম। গন্ধে প্রাণ আনচান করে ওঠে। এ রকম একটা আফটারশেভ লোশন কিনতে হবে। আরও কত কী কেনার কথা মনে পড়ছে সারা দিন! অবশ্যই একটা সেফটি রেজার। কিছু খুব নতুন ডিজাইনের জামা-কাপড়, একটা ঘড়ি, একটা রেডিয়ো…
ক্ষণা স্নান করতে গেল। সেই ফাঁকে যথাসাধ্য সাজপোশাক পরে নিয়েছি। সুবিনয় আমাকে আপাদমস্তক ভাল করে দেখে নিয়ে বলল, নট ব্যাড। কিন্তু, তুই একটু রোগা। ইউ নিড মাচ প্রোটিন অ্যান্ড এনাফ কারবোহাইড্রেট। কাল সকালেই ডাক্তার দত্তকে দিয়ে একটা থরো চেক আপ করিয়ে নিবি। গুড ফুড অ্যান্ড গুড মেডিসিন উইল মেক ইউ এ হ্যান্ডসাম ম্যান। মনে রাখবি ফিজিকাল অ্যাট্রাকশনে আমাকে বিট করা চাই।
আমি একটু ম্লান হেসে বললাম, টারজান, তোমার হাইট আর বিশাল স্বাস্থ্য কিছুতেই আমার হওয়ার নয়।
সুবিনয় ভ্রু কুঁচকে একটু ভেবে বলল, দেন ট্রাই টু ইমপ্রেস হার বাই আর্ট অর লিটারেচার অর বাই এনি ড্যাম থিং। আই ডোন্ট কেয়ার। আই ওয়ান্ট কুইক অ্যাকশন।
মাথা নাড়লাম।
সুবিনয় একটা সেলফ-টাইমারওলা ক্যামেরা আর একটা সুপারসেনসিটিভ খুদে টেপ-রেকর্ডার এয়ার ব্যাগে ভরে দিয়েছিল। সেইটে কাঁধে ঝুলিয়ে ক্ষণাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠলাম। বাচ্চারা ঠাকুমার কাছে রয়ে গেল। সুবিনয়ের সাত বছরের মেয়ে দোলনা তেমন ঝামেলা করেনি, কিন্তু পাঁচ বছরের ছেলে ঘুপটু সঙ্গে যাওয়ার জন্য ভীষণ বায়না ধরছিল। ক্ষণার খুব ইচ্ছে ছিল সঙ্গে নেয়, কিন্তু সুবিনয় দেয়নি।
ট্যাক্সি ছাড়বার সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষণা আর আমি একা। আমার বুকের মধ্যে ঢিবঢিব ভয়ের শব্দ। গলা শুকনো। শরীর কাঠের মতো পক্ষাঘাতগ্রস্ত। কিন্তু ক্ষণার কোনও ভয়ডর নেই, স্নায়ুর চাপ নেই। সে আমাকে বাড়ির ফাইফরমাশ করার লোক ভিন্ন অন্যকিছু মনে করে না।
ট্যাক্সির জানালা দিয়ে আসা বাতাসে ক্ষণার আঁচল উড়ে এসে একবার আমার কাঁধে পড়ল। ক্ষণা আঁচল টেনে নিয়ে বলল, আপনার পোশাক-আশাকে কিছু বাসি নেই তো৷ পুজো দেব ছোঁয়া-টোঁয়া লাগলে বিশ্রী।
এই ক্ষণার সঙ্গে প্রেম! ভারী হতাশ লাগল। বললাম, না, কিছু বাসি নয়।
নিশ্চিন্ত হয়ে ক্ষণা তার হাতের সন্দেশের বাক্স আর শালপাতায় মোড়া ফুল আর ভ্যানিটি ব্যাগ দুজনের মাঝখানে সিটের ফাঁকা জায়গায় রাখল।
ধাঁ ধাঁ করে ট্যাক্সি এগিয়ে যাচ্ছে। পথ তো অফুরান নয়। এখন আমার কিছুটা সহজ হওয়া দরকার। দুটো-চারটে করে কথা এক্ষুনি বলতে শুরু না করলে সময়ের টানাটানিতে পড়ে যাব।
একবার সন্তর্পণে ক্ষণার দিকে তাকালাম। না-সুন্দর, না কুৎসিত ক্ষণা পিছনে হেলে বসে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। আমাকে গ্রাহ্যের মধ্যেও আনছে না। আমি তার চলনদার মাত্র, তার বেশি কিছু নই। কিন্তু এ ভাবটা ভেঙে দেওয়া দরকার।
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই হঠাৎ ক্ষণা আমার দিকে চেয়ে বলল, ও এল না কেন বলুন তো!
আচমকা ক্ষণার কণ্ঠস্বরে একটু চমকে গিয়েছিলাম। এমনিতে চমকানোর কথা নয়, প্রতি দিনই ক্ষণার সঙ্গে আমার কিছু কথাবার্তা হয়। কিন্তু এখন আমার মনটা এত বেশি ক্ষণাকনশাস হয়ে আছে যে, ও নড়লেও আমার হৃৎপিণ্ডে ধাক্কা লাগছে।
বললাম, মিটিং-এর কথা বলছিল।
নিজের গলাটা কেমন মিয়োনো শোনাল।
ক্ষণা এক-দুই পলক আমার দিকে চেয়ে বলল, রোজই যে কেন মিটিং থাকে বুঝি না। লোকেরা এত মিটিং করে কেন?
বুঝতে পারলাম ক্ষণা একটা ক্যাচ তুলেছে। লুফতে পারলে আউট।
ব্যাগে হাত ভরে টেপ-রেকর্ডারটা চালিয়ে দিয়ে বললাম, এই একটা ব্যাপারে আপনার সঙ্গে আমার ভীষণ মিল। আমিও মিটিং পছন্দ করি না।
ক্ষণা মিলটা পছন্দ করল কি না জানি না, বলল, অবশ্য ইম্পর্ট্যান্ট লোকদের প্রায় সময়েই মিটিং করতে হয়। ইম্পর্ট্যান্ট হওয়ার অনেক ঝামেলা।
দক্ষিণ কলকাতা পার হয়ে গাড়ি চৌরঙ্গি অঞ্চলে পড়ল। টেপ-রেকর্ডার চলছে।
আমি বললাম, আপনি গান ভালবাসেন?
গান কে না ভালবাসে! কেন বলুন তো?
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, আমি একসময় গাইতাম।