বললাম, করব।
.
০৯.
প্যাকিং বাক্সের ওপর কষ্টকর বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিল না রাতে। গ্রিলের চৌখুপি দিয়ে নীলাভ আকাশ দেখা যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ। জ্যোৎস্নার অনেক টুকরো এসে পড়েছে আমার গায়ে, বিছানায় উঠে বসে আমি দুহাতের শূন্য আঁজলা পাতলাম। হাত ভরে গেল জ্যোৎস্নায়। কী অনায়াস, অযাচিত জ্যোৎস্না। ঠিক এইরকমভাবে আমি বরাবর পয়সা চেয়েছি। ঠিক এইরকমভাবে আঁজলা পেতে। অনায়াসে।
ঠিক এই সময়ে আমার বিছানার পায়ের দিকটায় আমার বিবেককে বসে থাকতে দেখলাম। হুবহু যাত্রাদলের বিবেকের মত কালো আলখাল্লা পরা, গালে দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে একটা বাদ্যযন্ত্র। সে গান গাইছিল না, কিন্তু কাশছিল। কাশতে কাশতেই একটু ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, কাজটা কি ঠিক হবে উপলচন্দ্র?
একটু রেগে গিয়ে বলি, কেন, ঠিক হবে না কেন? আমি কাজটা করি বা না করি, সুবিনয় ডিভোর্স করবেই। ডিভোর্স না পেলে হয়তো খুনই করবে ক্ষণাকে। ভেবে দেখো বিবেকবাবা, খুন হওয়ার চেয়ে ডিভোর্সই ভাল হবে কি না ক্ষণার পক্ষে।
উপলচন্দ্র, বড্ড বেশি অমঙ্গলের সঙ্গে জড়াচ্ছ নিজেকে। খারাপ হয়ে যাচ্ছ। ওই হাজার টাকা হাতে না-পেলে তুমি ঠিকই বুঝতে পারতে যে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
আমি আমার বিবেকের কাছ ঘেঁষে বসে বললাম, শোনো বিবেকবাবা, তোমাকে বৈকুণ্ঠ ফোটোগ্রাফারের গল্পটা বলি। তেঠেঙে একটা পুরনো ক্যামেরা নিয়ে ফোটো তুলে বেড়াত সে। ছেলেবেলায় সে অনেক বার আমাদের গ্রুপ ফোটো তুলেছে। ক্যামেরার পিছনে কালো কাপড় মুড়ি দিয়ে সে অনেকক্ষণ ধরে তাক করত। এত সময় নিত যে আমাদের ধৈর্য থাকত না। বৈকুণ্ঠ তার খদ্দেরদের ধৈর্য নিয়ে মাথা ঘামাত না, সে চাইত একেবারে নিখুঁত ফোটোগ্রাফ তুলতে। শতবার সে এসে একে বাঁ দিকে সরাত, ওকে ডান দিকে হেলাত, কারও ঘাড় বেঁকিয়ে দিত, কারও হাত সোজা করত, কাউকে বলত মুখটা ওপরে তুলুন, ‘আঃ হাঃ আপনাকে নয়, আপনি মাথাটা একটু নামান।‘ এইভাবে ছবি তোলার আগে বিস্তর রিহার্সাল দিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন সে ক্যামেরায় ফিল্মের প্লেট ভরে লেন্সের ঠুলি খুলবার জন্য হাত বাড়াত তখন খুব আশা নিয়ে দম বন্ধ করে বসে আছি, এইবার ছবি উঠবে। কিন্তু একেবারে শেষ মুহূর্তে বৈকুণ্ঠ হঠাৎ বলে উঠত, উহুঃ! ঠুলি থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে সে আবার এসে হয়তো কোনও বাচ্চার বুকের বোতাম এঁটে দিয়ে যেত। আবার সব ঠিকঠাক, আবার তুলিতে হাত, ফোটো উঠবে, আমার শরীর নিশপিশ করছে উত্তেজনায়। উঠবে উঠল বলে। কিন্তু ঠিক শেষ সময়ে বৈকুণ্ঠ আবার অমোঘভাবে বলে উঠত, উহুঃ! হতাশায় ভরে যেত ভিতরটা। বৈকুণ্ঠ এসে কাউকে হয়তো একটু পিছনে সরে যেতে বলল। আবার সব রেডি। ঠুলিতে হাত। ছবি উঠল বলে! কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে আবার সেই—উহুঃ! শোনো বিবেকবাবা, আমার ভাগ্যটা হচ্ছে ঠিক ওই বৈকুণ্ঠ ফোটোওয়ালার মতো। যখনই কোনও একটা দাও জোটে, যখনই কোনও পয়সাকড়ির সন্ধান পাই, যখন সব অভাব ঘুচে একটু আশার আলো দেখতে পাই, ঠিক তখনই বেশ। আড়াল থেকে কে বলে ওঠে, উহুঃ!
আমার বিবেক ঘন ঘন মাথা নাড়ছিল।
আমি বললাম, নইলে বলল, কন্ডাক্টারি করতে গিয়ে কেন নির্দোষ মানুষ সেই হাটুরে মারটা খেলাম? গোবিন্দর বাড়িতে না হোক চোর-তাড়া করে খেদালে। ডাকাতি করতে গিয়ে প্রথম চোটেই কেন কাজ ঢিলা হয়ে গেল! কোথাও কিছু না, মানিক সাহার ঘাড়ে যখন নিশ্চিন্তে চেপে বসেছি তখনই হঠাৎ তাকেই বা ভাবের ভূতে পেল কেন? সারাদিন আমার পেটে এক নাছোড় খিদের বাস। মাথায় চৌপর দিন খিদের চিন্তা। বিবেকবাবা, একটু ভেবে দেখো, এই প্রথম আমি এক থোকে এত টাকা হাতে পেলাম। বোমা ফাটবার মতো টাকা, জলপ্রপাতের মতো টাকা। এ কাজটা আমাকে করতে দাও। বাগড়া দিয়ো না বিবেকবাবা, পায়ে পড়ি।
আমার বিবেক একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, উপলচন্দ্র, টাকাটা তোমাকে বড় কাহিল করে ফেলেছে হে। শোনো বলি, টাকা থাকলেই যে মানুষ গরিব হয় না তা কিন্তু নয়। দুনিয়ায় দেখবে, যার যত টাকা সে তত গরিব।
আমি আমার বিবেককে হাত ধরে তুলে বললাম, শোনো বিবেকবাবা, এই যে প্যাকিং বাক্স সব দেখছ, এতে করে নানা দেশ থেকে হাজার রকমের কেমিকাল আসে। তার সবটুকু তো আর কোম্পানিতে যায় না। বেশির ভাগই চড়া দামে চোরাবাজারে বিক্রি হয়ে যায়। সুবিনয়ের পয়সার ঢলাঢলি। সেই পয়সার কিছু যদি আমার ভোগে লাগে তো লাগতে দাও। তাতে ওর পূণ্য হবে। দোহাই বিবেকবাবা, আজ তুমি যাও। আজ যাও বিবেকবাবা। আমি একটু নিজের মত থাকি।
বিবেক গ্রিলের বন্ধ দরজা ভেদ করে চলে গেল। জ্যোৎস্নায় আর তার চিহ্নও দেখা গেল না।
আর রবিবার। ডি-ডে।
আজ ক্ষণাকে নিয়ে সুবিনয়ের দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্ল্যান মাফিক আজ সকালেই সুবিনয়ের জরুরি কাজ পড়ে গেল। আমাকে ডেকে বলল, উপল, তুই ক্ষণাকে দক্ষিণেশ্বর থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয় তো! আমার একটা মিটিং পড়ে গেল আজ। স্টেটস থেকে একটা ডেলিগেশন এসেছে।
ক্ষণা বলল, থাক গে, আমারও তা হলে যাওয়ার দরকার নেই। পরের রবিবার গেলেও হবে।
সুবিনয় আঁতকে উঠে বলল, না না, তুমি যাও। পুজো দেবে মনে করেছ যাবে না কেন? উপল, তুই বরং দাড়ি-টাড়ি কামিয়ে রেডি হয়ে নে।