আমি বললাম, প্লিজ, বকবেন না। ওর মন খুব খারাপ।
কেন?
ওর এ প্রেমটাও কেঁচে গেছে।
রুমা কিছু বলার আগেই সিঁড়িতে প্রচণ্ড ভারী পায়ের শব্দ তুলে সুবিনয় নেমে আসছিল। তার বাঁ কাঁধে একটা পাট করা চাদরের মতো প্রীতির প্রেমিক ভাঁজ হয়ে ঝুলে আছে।
রুমাকে দেখে সুবিনয় খুব স্মার্ট হেসে বলল, লোকটা নেশা করে হল্লা করছিল, নিয়ে যাচ্ছি।
দৃশ্যটা দেখে অসম সাহসী রুমাও শিউরে উঠে কাছে সরে এসে আমার একটা হাত জোরে চেপে ধরে বলল, উঃ মা গো! এ লোকটা কে?
আমি সান্ত্বনার ছলে রুমার ভেজা এলোচুলে একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললাম, কিছু ভয়ের নেই। আপনি ভয় পাবেন না। আমি তো আছি।
রুমা আমার বুকের সঙ্গে প্রায় লেগে দাঁড়িয়েছিল, এ কথা শুনে হঠাৎ ছিটকে সরে গিয়ে বলল, স্কাউড্রেল।
আমি তবু রাগ করি না। মলিন একটু হাসি। সুবিনয় গিয়ে প্রীতির প্রেমিকের জেফির গাড়ির দরজা খুলে পিছনের সিটে প্রেমিককে শুইয়ে দিয়ে নিজে হুইলে বসল। তারপর ডাকল, উপল, চলে আয়।
রুমা আমার দিকে অবাক হয়ে চেয়ে হঠাৎ বলল, আপনি নিশ্চয়ই গুন্ডা লাগিয়েছিলেন, না? আপনি… আপনি…।
বলতে বলতে রাগে হঠাৎ রুমার ভিতরে সেই ডালমিয়া পার্কের ভলিবল খেলোয়াড়টা জেগে উঠল। তেমনি চিতাবাঘের মতো চকিত ভঙ্গি, তেমনি নিশ্চল নিবদ্ধ চোখে বলের বদলে আমার মুখের দিকে চেয়ে। তারপর হঠাৎ স্বভাবসিদ্ধ লঘু পায়ে ছুটে এসে তার প্রচণ্ড স্মাশিং-এর ডান হাতখানা তুলল।
আমারও অভিজ্ঞতা বেড়েছে। আগের বারের মতো বোকা দর্শক আমি আর নেই এখন। মাথাটা সরিয়ে নিলাম পিছনে। রুমার আঙুলের ধারালো ডগা কেবল থুতনি ছুঁয়ে গেল।
এক লাফে বাইরে এসে দৌড়ে ফুটপাথ পার হচ্ছি, রুমাও ছুটে এল, পিছন থেকে জামা টেনে ধরার চেষ্টা করল। গাড়ির দরজা খুলতে সুবিনয়ের যেটুকু সময় লেগেছিল সেটুকুর মধ্যে সে আমার গালে নখের আঁচড় বসিয়ে দিল। হাত টেনে ধরার চেষ্টা করল। চেঁচিয়ে লোকজনকে জানান দিতে লাগল, চোর! খুনে! গুন্ডা! পাকড়ো-।
সুবিনয় গাড়ি ছেড়ে দিল। লেকের একটা নির্জন ধারে এক জায়গায় গাড়িটা প্রীতির প্রেমিক সমেত রেখে দিয়ে সুবিনয় আমাকে নিয়ে ফিরতে লাগল।
.
০৮.
মঞ্চসজ্জা একই। সুবিনয়ের সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটের বাইরের ঘর। তেমনি আন্ডারওয়্যার আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে সুবিনয় সোফায় চিতপাত হয়ে বসে আছে। সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে একটানা। ফ্ল্যাটে ফিরে এসেই সে প্রীতির কাছ থেকে টুকে-আনা তার প্রেমিকের বাড়ির ফোন নম্বরে ডায়াল করে জানিয়ে দিয়েছে, ঠিক কোথায় এলে তারা লোকটার অচৈতন্য দেহটি খুঁজে পাবে। এখন সে খুবই শান্ত মেজাজে বসে আছে।
আমার গাল থেকে ডেটলের গন্ধ নাকে আসছে। শরীর কিছু দুর্বল লাগছিল। বুকে একটা ভয়।
সুবিনয় তেমনি মুখের এক পাশে আলো আর অন্য পাশে অন্ধকার নিয়ে হঠাৎ মাথাতোলা দিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ও আর বাঙালি সুবিনয় নেই। ওর মুখে, চোখে চেহারায় বিদেশি ছাপ পড়ে গেছে। কখন যে পড়ল কে জানে!
ও হুবহু মার্কিন উচ্চারণে বলল, ইউ নো সামথিং বাডি?
আমি সভয়ে তাকিয়ে রইলাম।
ও আপন মনে একটু হেসে বলল, উই আঃ গোয়িন টু সেল ইন দ্য স্টেটস। হেল্লুভা গুড কান্ট্রি।
আমি মাথা নাড়লাম। ডেটলের গন্ধটাউবে যাচ্ছে ক্রমে। গালটা জ্বালা করছে অল্প অল্প।
সুবিনয় উঠল। দেওয়াল-আলমারি খুলে একটা হুইস্কির বোতল বার করে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল খানিকটা। হাতের পিঠে মুখটা মুছে নিয়ে উজ্জ্বল চোখে আমার দিকে ফিরে বলল, উই ওয়্যার লাভারস ইন আমেরিকা, উই শ্যাল বি লাভারস ইন আমেরিকা। ইউ নো বাডি?
আমি মাথা নাড়লাম। বুঝেছি।
সুবিনয় আরও খানিকটা নিট হুইস্কি খেয়ে এসে আবার চিতপাত হয়ে সোফায় বসে বলল, আই’ল হ্যাভ প্রীতি, প্রসপেক্ট অ্যান্ড এভরিথিং ইন দ্য স্টেটস। দ্যাটস দ্য কান্ট্রি ফর আস। গিমমি আমেরিকা বাডি, গিমমি আমেরিকা।
বলে একটু হাসে সুবিনয়। তারপর গম্ভীর হয়ে হঠাৎ উঠে সোজা হয়ে বসে বাংলায় বলে, কিন্তু যাওয়ার আগে দুটো খুব জরুরি কাজ আছে।
আমার খিদেটা ক্রমে পেটের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। জাগছে। খোঁচা দিচ্ছে আমাকে। আমি একটু কোলকুঁজো হয়ে বসে সুবিনয়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকি।
সুবিনয় বলে, প্রথম কাজ, ক্ষণাকে ডিভোর্স করা। দ্বিতীয় কাজ, টু ইনভেন্ট এ প্যালেটেবল পয়জন ফর দ্য মাইস অফ ইন্ডিয়া। ভারতবর্ষের ইঁদুরদের জন্য একটি সুস্বাদু বিষ।
উঠে পায়চারি করতে করতে সে বলল, দ্বিতীয় কাজটা অনেকখানি এগিয়েছে। ইট উইল বি এ রিভলিউশনারি ইনভেনশন। কী রকম জানিস?
কী রকম?
অনেকটা যেন স্বপ্নের ভিতর থেকে সুবিনয় বলল, অসম্ভব টেস্টফুল বিষ। যেখানেই রাখবি গন্ধে গন্ধে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ইঁদুর ছুটে আসবে আনাচকানাচ থেকে। গর্ত থেকে বেরিয়ে আসবে, আসবে আলমারির তলা থেকে, বইয়ের র্যাক থেকে, ভাড়ার ঘর থেকে। অসম্ভব তৃপ্তির সঙ্গে চেটেপুটে খাবে, তারপর ঘুমিয়ে পড়বে চিরদিনের মতো। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা যেমন টেনে নিয়ে গিয়েছিল ইঁদুরদের, অনেকটা তেমনি। সারা দেশে ইঁদুরদের সমস্ত নড়াচড়ার শব্দ থেমে যাবে। শুধু জমে থাকবে এখানে-সেখানে ইঁদুরের স্তূপ।