এই নকল লোকটা আমিই। রোজ রাতে সুবিনয় তার সাউথ এন্ড পার্কের ফ্ল্যাটে অপেক্ষা করত, আমি গিয়ে তাকে সারা দিনের রিপোর্ট দিতাম। গম্ভীর হয়ে সুবিনয় শুনত, আর একটা কাগজে কখন কে বেরোয়, আর কে ঢোকে তার একটা টাইম চার্ট তৈরি করত। গেঞ্জি আর আন্ডারওয়্যার পরা তার সুবিশাল চেহারাটা খুনির মতো দেখায় রোজ।
একদিন অনেক হিসেবের শেষে সে বলল, উপল, রাত সাড়ে সাতটা থেকে আটটা হচ্ছে সবথেকে সেফ সময়। রুমা রোজই সাড়ে আটটায় ফেরে। প্রীতি আর তার লাভার ফেরে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে। মাদ্রাজি ছেলেরা ন’টার আগে কমই ফেরে, দু’-একজন আগে ফিরলেও ক্ষতি নেই।
আমি আঁতকে উঠে বলি, ক্ষতি নেই কীরে? ওরা থাকলে
সুবিনয় গম্ভীর হয়ে বলে, চার-পাঁচজনকে আমি একাই নিতে পারব। খুব বেকায়দা দেখলে তুই হেল্প করবি।
তার দরকার কী?
দরকার কে বলেছে! যদি বাই চান্স ফেরে তবেই দরকারের কথা ওঠে। বাকি থাকছে একজোড়া স্বামী-স্ত্রী। এদের আচরণ আনসার্টেন। ওরা বিশেষ কোনও দিন সিনেমায় যায় না?
না। দুদিন যায় না, তারপর যায়, আবার হয়তো তিন দিন যায় না, এইরকম আর কী!
আনওয়াইজ অফ দেম। যাকগে, অত ভাবলে চলে না।
না ভাবলেও চলবে না।
সুবিনয় আমার মুখের দিকে স্থির চেয়ে বলল, প্রীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল বলে আমেরিকায় আমি একটা ছোকরাকে ঠেঙিয়েছিলাম খোলা রাস্তার ওপর। তাতে কিছু হয়নি। অত ভাবলে চলে না।
আমি অসহায়ভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
পরদিনই সুবিনয় প্রীতির ফ্ল্যাটবাড়িতে হানা দিল।
কপালটা ভালই সুবিনয়ের। সেদিন মাদ্রাজি ছেলেরা কেউ ছিল না। স্বামী-স্ত্রীও সেদিন সিনেমায় গেছে। রুমাও যথারীতি বাইরে। এবং প্রীতি আর তার প্রেমিকও সেদিন দুর্ভাগ্যবশত সাড়ে সাতটায় ফিরে এল।
সুবিনয় সিঁড়ির নীচের অন্ধকারে অপেক্ষা করছিল, আমি উলটো দিকের ফুটপাথে। প্রীতি তার প্রেমিককে নিয়ে দোতলায় উঠল দেখলাম। ঠিক তার কয়েক সেকেন্ড পর সুবিনয়ের বিশাল চেহারাটা বেড়ালের মতো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। পেছনে আমি।
ভেজানো দরজা ঠেলে সুবিনয় ঘরে ঢুকল। প্ল্যান মাফিক আমিও ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনি আটকে পাল্লায় পিঠ দিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু কী ঘটছে তা দেখার সাহস আমার ছিল না। দরজার পাল্লায় পিঠ দিয়েই আমি চোখ বুজে কানে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। টের পাই সামনে শিক শিক, চপ, মাগো, গড, ধুপ গোছের কয়েকটা আওয়াজ হল। তারপর সব চুপচাপ।
চোখের পাতা জোর করে বন্ধ করায় ব্যথা হচ্ছিল, কানে-দেওয়া আঙুল টনটন করছে, কানের মধ্যে দপ দপ আওয়াজ হচ্ছে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকা যায় না।
তাই অবশেষে চোখ-কান খোলা রাখতে হল।
তেমন কিছু হয়নি। ঘরের আসবাবপত্র ভাঙচুর হয়নি, লণ্ডভণ্ডও হয়নি। প্রীতি তার ঘোরানো চেয়ারে মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পায়ের কাছেই পড়ে আছে প্রেমিক। প্রেমিকের চশমা একটু দূরে কার্পেটের ওপর ডানাভাঙা পাখির মতো অসহায়। সুবিনয় প্রীতির সামনে কোমরে হাত দিয়ে ওয়েস্টার্নের নায়কের মতো দাঁড়িয়ে।
পুরো একখানা বিদেশি স্টিল ছবি।
সুবিনয় ডাকল, প্রীতি, হানি, ডার্লিং!
উ! স্বপ্নের ভিতর থেকে প্রীতি জবাব দিল।
তুমি কি আমাকে ভালবাসো না?
স্বপ্নের দূর গলায় প্রীতি বলল, বাসতাম। আমেরিকায়।
সুবিনয় গর্জে উঠল, আমেরিকায়? তা হলে আমরা আবার আমেরিকায় চলে যাই চলো। সেখানে তুমি আবার আমাকে ভালবাসবে।
অনেকক্ষণ ভেবে প্রীতি ওপর নীচে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, তাই যেতে হবে। এ দেশে থাকলে তোমাকে ভালবাসা অসম্ভব। নানা সংস্কার বাধা দেয়।
প্রীতির পড়ে-থাকা প্রেমিকের একখানা হাত সুবিনয় জুতোর ডগা দিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, এ ছেলেটা কে প্রীতি? কেমন ছেলে?
প্রীতি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ও একটা কাওয়ার্ড, একটা উইকলিং। এক ঘণ্টা আগেও ওকে আমি ভালবাসতাম।
এখন?– সুবিনয় গর্জন করে ওঠে।
এখন বাসি না।–প্রীতি মৃদুস্বরে বলল।
সুবিনয় কোমরে হাত রেখে টারজানের মতো হাসল। বন্য এবং সরল হাসি।
প্রীতি হাসল না। মাথা নিচু করে স্থির বসে রইল। চুলের ঘেরাটোপে মুখখানা ঢাকা।
দৃশ্যটা আমার কেন যেন বড্ড বিদেশি বলে মনে হচ্ছিল। যেন কলকাতায় নয়, নিউ ইয়র্ক বা টেক্সাসে ঘটনাটা ঘটছে। বিদেশি কোনও ছবিতে বা বইতে দৃশ্যটা কি দেখেছি বা পড়েছি? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার পেটের মধ্যে সেই স্থায়ী খিদের ভাবটা মৃদু মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।
বাস্তবিক, এইসব হৃদয়ঘটিত কোনও সমস্যাই আমার নেই। আমার একটাই সমস্যা, বড় খিদে পায়। অনেকক্ষণ ধরে নানা সুস্বাদু খাবার খেয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সুবিনয় মার্কিন প্রেমিকের মতো লম্বা এক পদক্ষেপে প্রীতির কাছটিতে পৌঁছতেই আমি চোখ বন্ধ করে কানে আঙুল দিই। তারপর অন্ধের মতো ঘুরে হেঁটে গিয়ে, হাতড়ে দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে আসি। সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকি নীচে।
ঠিক সদরের দরজায় রুমার সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। তার কাঁধে একটা ব্যাগ, মুখ গম্ভীর।
বলল, কী খবর?
আমি ডাইনে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে জানাই, কোনও খবর নেই।
ও আবার বলে, প্রীতি কি আপনাকে রিফিউজ করেছে!
একটু ভেবে নিয়ে আমি ওপরে-নীচে মাথা নাড়ি, করেছে।
ভেবেছিলাম, খুশি হবে। হল না। মুখখানা গোমড়া করে বলল, প্রীতি বড্ড বোকা। একজনের পর একজনের সঙ্গে ইনভলভড হয়ে যাচ্ছে। আজ ওকে একটু বকব।