ওপর থেকে বড়গিন্নি ডাক দিল, ঠাকুরঝি ভাত দিয়ে যাও।
মাসি এক হাতে থালা, অন্য হাতে ডালের বাটি নিয়ে উঠে গেল। ফাঁকা রান্নাঘরে বসে নিজেকে খুব খারাপ লাগল। আমার কত কিছু হওয়ার কথা ছিল! তার একটা কিছু হলে মাসি কি এ বাড়িতে রেঁধে খায়? একটু বাদে মাসি ফিরে এসে বলল, ওদের ফাইফরমাশ খাটিস নাকি?
খাটি।
খাটিস। না খাটলে ভালমতো খেতে দেবে না। বড়কে বলে রেখেছি ওর অফিসে তোকে একটা কাজ দিতে।
বড়বাবু আমাকে দেবে কেন? তার বড় ছেলেকে ঢোকাবে বরং।
তোকেও দেবে। বি কম পাশ চাট্টিখানি কথা নাকি! বড়র একটা ছেলেরও অত বিদ্যা আছে? তা ছাড়া তুই কত কী জানিস! গান, আঁকা, পাট করা।
মাসি পুরনো একটা কৌটো খুলে দু’-তিনটে পাউরুটির টুকরো বের করে আমাকে দিয়ে বলল,খা।
মাসির এই এক রোগ, কোনও কিছু ফেলবে না। আমাদের বাড়িতে লাউ বা আলুর খোসা পর্যন্ত ফেলত না, চচ্চড়ি বা ভাজা করে ফেলত। এমনকী পেঁপের খোসা পর্যন্ত রসুন-টসুন দিয়ে বেটে ঠিক একটা ব্যঞ্জন তৈরি করে ফেলত।
পাউরুটির টুকরোগুলো বিস্কুটের মতো। কটকটে শক্ত।
উনুনের ধারে রেখে রেখে করেছি। ভাল না?
ভালই। খেতে খেতে বলি, পয়সাকড়ি দেয় কিছু?
না। পয়সা দিয়ে হবেই বা কী? এক মাঝে মাঝে তোকে একটু জামা-টামা দিতে ইচ্ছে করে। কেমন এক ছোঁটলোকি পোশাক পরে বেড়াস। গোবিন্দর কেমন সব জামাকাপড়। কিন্তু কাজ-টাজ হয় না কেন তোর বল তো! তা হলে তোর কাছে থেকে দু’বেলা দুটো রেঁধে খাওয়াতাম।
ক্ষণার দেওয়া বাজারের পয়সা থেকে বা সারা বাড়ি আঁতিপাঁতি খুঁজে যা পয়সাকড়ি জমিয়েছি তা সবসুদ্ধ গোটা ত্রিশ টাকা হয়েছে। সেগুলো আনার সময় পাইনি আজ। সুবিনয়ের দেওয়া পাঁচটা টাকার যা অবশিষ্ট আছে তা থেকে দুটি টাকা পকেট থেকে বের করে মাসিকে দিয়ে বলি, রেখে দাও। কিছু খেতে-টেতে ইচ্ছে করলে কিনে খেয়ো।
কানা চোখে জল পড়ছিলই, এবার ভাল চোখ দিয়েও গড়াতে লাগল।
ঠাকুরঝি, ভাত আনো। বড়গিন্নি সিঁড়ির ওপর থেকে বলে।
যাই।–বলে মাসি বাটি-টাটি নিয়ে উঠে গেল।
রান্নাঘরটা ঝকঝক করছে পরিষ্কার। কোথাও একটু ঝুল কালি নেই, মেঝেয় গুচ্ছের জল পড়ে নেই, খাবার আটকা অবস্থায় রাখা নয়। মাসি এ সব কাজে পি-এইচ ডি।
মাসি খবরের কাগজে মোড়া একটা মুগার থান হাতে ফিরে এসে বলল, এটা দিয়ে দুটো জামা করিয়ে নিস।
হাতে নিয়ে দেখি, পুরনো হলেও আসল মুগার জিনিস। এখানে সেখানে কয়েকটা ছোপ ছোপ জলের দাগ বাদ দিলে এখনও ঝকমক করছে। বললাম, কোথায় পেলে?
বড়র মা মরে গেল তা বছর দুই হবে। তার সব বাক্স-প্যাটরা ঘেঁটে এই সেদিন পুরনো কাপড়-চোপড় যা বেরিয়েছিল তার থেকে বড়গিন্নি এইটে আমাকে দিয়েছে। তখনই ভেবে রেখেছি, তুই এলে জামা করতে দেব। ভাল দরজিকে দিয়ে বানাস। ভাল না জিনিসটা?
হুঁ।
কেতকীর সঙ্গে খুব ঝগড়া হচ্ছে বাড়ির সবার।
কেন?
কেন আর! মেয়েটা বড় ভাল, কিন্তু ওকে ছোঁড়ারা বড় যন্ত্রণা করে। ওর দোষ কী?
আমি চুপ করে থাকি। কেতকীর ব্যাপারে মাসির একটা দুরাশা আছে। মাসি চায়, কেতকীর সঙ্গে আমার বিয়ে হোক।
বললাম, মাসি, কেতকীকে নিয়ে অত ভেবো না। তাকে নিয়ে ভাববার অনেক লোক আছে।
মাসি দমের আলু সেদ্ধ করে খোসা ছাড়াচ্ছিল। বলল, কাকে নিয়ে না-ভেবে পারি বল। আপনা থেকেই সব ভাবনা আসে। এই যে গোবিন্দটা আজ বকুনি খেল সেই বসে বসে সারা দিনমান ভাবব। বড্ড গোবেচারা ছেলে। ডিমের নামে পাগল। কত দিন লুকিয়ে-চুরিয়ে আনে, বলে, ভেজে দাও। আমিও দিই।
মনটা একটু খচখচ করে। একদিন ছিল, যখন মাসির গোটা বুকখানা জুড়ে আমিই ছিলাম। এখন আবার সেই জায়গায় অন্য লোকজন একটু-আধটু ঠেলাঠেলি করে ঢুকে পড়ছে। দোষ নেই, আমি মাসির বল্গাছাড়া ছেলে, এক বুক মায়া নিয়ে মাসিরই বা একা পড়ে থাকতে কেমন লাগে। মায়া এমনিই, থাকতে থাকতে দেখতে দেখতে একজন না একজনের ওপর পড়ে যায়।
বললাম, কেতকীকে নিয়ে তুমি আর ভেবো না মাসি, আমার গতিক তো দেখছ।
মাসি একটা চোখে ছানি সত্ত্বেও বেশ খর করে তাকিয়ে বলল, হালগতিক খারাপটা কী? বরাবরই তুই একটু কুঁড়ে বলে, নইলে তোরটা খেয়ে লোকে ফুরোতে পারত না। মা যেমন ছেলে চেনে তেমন আর কে চিনবে রে? ও সব বলিস না। বোস একটু, দমটা কষাই, দু’খানা রুটি দিয়ে খেয়ে যা। না কি ভাত খাবি দুটো?
না, না। ঝামেলায় যেয়ো না। পাঁচটা কথা উঠে পড়তে পারে।
মাসি একটা মাত্র ছানিপড়া চোখ সার্চলাইটের মতো আমার ওপর ফেলল। স্টিমারের বাতি যেমন তীরভূমির অন্ধকার থেকে খানাখন্দ, গাছপালা ভাসিয়ে তোলে, মাসির চোখ তেমনি আমার ভিতরকার খিদে-টিদে, জ্বালা-যন্ত্রণা সব দেখে নিল।
বেশি কথার মানুষ নয়, আলুর দম চাপিয়ে ঝকঝকে একটা কাঁসার থালায় ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, লোকে তোকে সোনা হেন মুখ করে খেতে দেবে, তেমন কপাল করেছিস নাকি? যে বাড়িতে থাকিস তাবাও না জানি কত গালমন্দ শাপ-শাপান্ত করে তবে খেতে দেয়।
আমার খিদেটা কোনও সময়েই তেমন তৃপ্তি করে মেটে না। খুব তৃপ্তি করে খেলে পেটে যে একটা চমৎকার যুদ্ধবিরতির অনুভূতি হয়, তা আজকাল টের পাই না। সব সময়েই একটা খিদের ভাব থাকে, সেটা কখনও বাড়ে, কখনও কমে। কয়েক দিন আগে এক বিকেলে ক্ষণা সবাইকে আনারস কেটে দিয়েছিল। আমাকে কিছু কম, অন্যদের কিছু বেশি। সুবিনয় আনারস চিবিয়ে ছিবড়ে ফেলছিল। দেখলাম, ক্ষণাও ছিবড়ে ফেলে, সুবিনয়ের মাও। কিন্তু আমার আর ছিবড়ে হয় না। যত বার মুখে দিয়ে চিবোই, তত বার শেষ পর্যন্ত গিলে ফেলি। পাছে ওরা লোভী ভাবে, সেই ভয়ে একবার-দু’বার অতি কষ্টে একটু-আধটু ছিবড়ে ফেলেছি বটে, কিন্তু আগাগোড়া ছিবড়ে ফেলার ব্যাপারটাকেই আমার খুব অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। আমার তো আজকাল আখ খেলেও ছিবড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে না।