আমাকে বাতিল করে দিয়ে পিসিমা স্থানীয় সজ্জনদের একজনকে জিজ্ঞেস করলেন : আপনি কোন্ পার্টটা নিতে চান বনমালীবাবু?
বিদূষক। বনমালীবাবু বললেন।
কিন্তু এ বইয়ে তো কোনো বিদূষক নেই। কাতরকণ্ঠে আমি প্রতিবাদ করি।
আমার বিদূষকের পার্ট আমার নিজেরই বানানো আছে। সগর্বে জানালেনবনমালীবাবু : মুখস্তই রয়েছে আমার। ইsটেজে দাঁড়িয়ে তাই গড় গড় করে আউড়ে যাব।
বেশ, বিদৃষকের পার্টই রইলো আপনার। প্রত্যেক দৃশ্যের আরম্ভে বিদূষক হয়ে আপনি সেইটে স্বগতোক্তি করবেন। ইংরেজিতে করবেন। ভালোই হবে বেশ। বললেন পিসিমা।
এবং তারপরে আরো ভালোও হলো, হতে থাকলো। অভিনেতাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে বইটাকে আরো যতদূর বেখাপ্পা করা যায় করা গেল। উচ্চাঙ্গের নাট্যকারিতা এবং সূক্ষ্ম কলাজ্ঞান নিয়ে এই আমাকেই করতে হলো সেই সব। কেবল বিদূষকই নয়, সকলের সখই মেটালাম। একজোড়া বাদশা-বেগমকেও ঝমঝমাঝম করে বইয়ের মধ্যে এনে ফেললাম। এবং সেই দ্বৈত সঙ্গীতেও কূল পাওয়া গেল না, চন্দ্রগুপ্ত থেকে চাণক্যের একটা দৃশ্যও টেনে আনতে হলো। নতুন ম্যারপ্যাচেই। (পিসিমা সকলের ঐক্য চান কি না! এবং) সেখানেই ফুরোলো না, একটি ছোট মেয়ের সুবিধার জন্য ছোটিসে দুনিয়ারে? বলে বেশ মোটাসোটা একটা হিন্দি গান ধরে পাকড়ে নিয়ে এসে নাটকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো।
এবং ঠিক হলো সাদা বাংলাতে অভিনয় করাই সিধে হবে। বিদেশী সৈনিকরা যত বুঝতে পারবে না ততই বেশি আপ্যায়িত হবে, আর ততই আমাদের উচ্চ আদর্শ তাদের অভিভূত করবে। অতএব, সমস্ত বইটা আবার নতুন করে বাংলায় অনুবাদ করার ভার পড়লো আমার উপর।
করে দিলাম। অনুবাদ করতে গিয়ে আনকোরা আরেক নাটক হয়ে দাঁড়াল—তা হোক। এদেশী বেড়ালই কাবুলে বেড়াতে গেলে কাবুলিবেড়াল হয়ে যায়, তারপর ঘুরে ফিরে ফের বাংলায় এলে ম্যালেরিয়ায় ভুগে কাঠবেড়াল হয়ে পড়ে কে না জানে? নাটকের পরাকাষ্ঠা দেখে আমাকেও কাঠ হয়ে যেতে হলো।
তারপর কয়েকদিন ধরে রিহার্সাল চলবার পর কৃষ্ণকান্তি বাবু বললেনঃ আচ্ছা বইটা কোথায় আমরা ষ্টেজ করব, শুনি?
একটা কাজের কথাই তিনি বল্লেন, এতদিনে।
কেন, এখানকার টাউন হলে। বল্লেন পিসিমা। তাছাড়া আর কোথায় হবে?
তাহলে টাউন হলটা রিজার্ভ করে ফেলুন আগে। প্রত্যহই যেরকম সভা সমিতির হিড়িক চলেছে তাতে সহজে ও জায়গা খালি পাওয়া যায় না। একটা তারিখ নিয়ে রাখুন আগের থেকে।
আমি দেখলাম এই সুযোগ। সিনসিটারের দায় থেকে রেহাই পাবার এই যাক। অমনি বেঁকে দাঁড়ালাম: কবে তোমাদের টাউন হল পাওয়া যাবে তদ্দিন এখানে বসে থাকা আমার পক্ষে পোষাবে না। আমার অনেক কাজ কলকাতায়। জরুরী কাজ যত। এই শনিবারই আমায় যেতে হবে। বলে দিলাম পিসিমাকে।
তাহলে এই শুক্রবারটাই ঠিক করে ফ্যালো। যাও, এক্ষুনি টাউন হলের কর্তাদের সঙ্গে কথা কয়ে ঠিকঠাক করে এসো গে।
আমার ওপরেই পিসিমা ভার চাপান, বিশ্বের যত ভার—ভারবাহী এই একমাত্র কাঁধের ওপর।
কথা কইলাম গিয়ে। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গেই কথা কইতে হলো। শুনতে না শুনতেই ভয়ঙ্কর ঘাড় নাড়তে লাগলেন তিনি।
অসম্ভব। একেবারে অসম্ভব। আমি ভারী দুঃখিত। এই শুক্রবার তো হয় না। শুক্রবার কেন, সারা সপ্তাহে এবং আগামী সপ্তাহেও একদিনের জন্যেও টাউন হল খালি নেই। এবং বলতে কি, সৈন্যরাই এই শুক্রবার ওটা নিয়ে রেখেছে।
বটে?
আমেরিকান সোলজারদের একদল ছেলে আমোদ প্রমোদের পক্ষপাতী। স্থানীয় লোকদের আনন্দ দেবার জন্যে আমেরিকান তামাসা বলে কী একটা পালা তারা দেখাবে। একটা খুব চটুল, হালকা, হাসির জিনিস–যদুর আমি টের পেয়েছি–
এবার আমার হাসি পায়। হাসি পায়। হাসি পায় সত্যিই। আমার প্রাক্তন নাটকের সমস্ত হাসি আমাকে পায়।
ভালো কথা, একটা কথা মনে পড়লো চেয়ারম্যানের চেহারা মুহূর্তের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে: আপনারাও সৈন্যদের আনন্দ দিতে চান, তাই বল্লেন না? ওরা আনন্দ চায় না। যথেষ্ট আনন্দেই আছে, তবে এই অভিনয়ের ব্যাপারে একজন ওস্তাদ লোকের দরকার ছিল ওদের, বলছিল ওরা। সেদিক দিয়ে সম্ভব হলে আপনি ওদের একটু সাহায্য করুন না? করবেন? আঃ, বড় খুশি হলুম। না, না, অভিনয় নয়, সে সব না, এই সিসিফারের কাজ শুধু। সামান্য কাজ, এমন কিছু কষ্টকর না, দুঃসাধ্যও নয়, কিন্তু এর জন্যে লোক পাওয়া মুস্কিল। কী বলে আপনাকে যে আমার কৃতজ্ঞতা জানাবো। আমার একান্ত আন্তরিক ধন্যবাদ।
৪. দশশালা বন্দোবস্তে বাংলাদেশের যে বেজায় ক্ষতি
দশশালা বন্দোবস্তে বাংলাদেশের যে বেজায় ক্ষতি হয়েছে তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না, আমার এক শালার ব্যবহারেই তা বোঝা যায়। শালা যে কী চীজ আমি তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। একজনের ধাক্কায় আমার একলার যা দুর্দশা করেছে তার পরিমাণকে দশগুণ বাড়িয়ে দশজনার পরিণাম খতিয়ে বার করা খুব কঠিন নয়। এমন কিছু শক্ত আঁক না।
তাহলে, গোড়া থেকেই শুরু করা যাক—
এই যে, সুচিত্র যে! এমন হঠাৎ?— আমার উচ্চস্বরে অভ্যর্থনা অথবা অভিযোগ, কী প্রকাশ পায় বলতে পারিনেঃ আপিসের ছুটি-টুটি না কি?
এই সকালে আর এমন অকালে বিনা নোটিশে সুচিত্রব আবির্ভাব আমার বিচিত্র বলেই মনে হয়।
ওর আসা-যাওয়া, প্রায় ধূমকেতুর মতই, এতই কখনো কদাচ যে, কল্পনাকেও একটু ভাবিত না করে পারে না।
বাড়ির খবর সব ভালো তো দাদা? জিজ্ঞেস করে ও।