টাকা না পাই না পাবো। আমার নাম হলেই হলো। বললাম পিসিমাকে।
হতে পারত নাম, কিন্তু হালকা জিনিস হয়েই মাটি করেছে। বললেন পিসিমা প্রথমতঃ, এর ইংরিজি অনুবাদ করা, শক্ত হবে,
কেন, অনুবাদ আবার কিসের জন্যে?
সৈন্যদের জন্যই। সম্প্রতি এখানে-আসা আমেরিকান সৈন্যদের আমোদিত করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে একটা ছোটখাট অভিনয়ের আয়োজন করেছি, বলিনি তোমায়?
না তো? আমি আকাশ থেকে পড়লাম—একেবারে হতাশ হয়ে।
বলবার সময় পেলাম কই? তোমরা আসা অবধি তো বসে বসে এই ছাই পাশ শুনছি। এর মধ্যে ফাঁক পেয়েছি বলবার? উলটে পিসিমারই অভিযোগ শুনতে হলো।
নাট্যকার-জীবনে এহেন কঠোর সমালোচনা অলভ্য নয়, ঘরে-বাইরে চার ধার থেকে কতোই শুনতে হয়েছে, নাটকের প্রতি আঘাত নিজের প্রতি আঘাত বিবেচনা করলেও একেবারে ভেঙে পড়লাম না। কেবল নাট্যকারেরাই এই অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে—ভেঙে না পড়বার ক্ষমতা। তাহলেও বেশ একটু মচকে যেতে হলো? তা হলে তুমি বলছো সৈন্যদের জন্য এটা চলতে পারে?
সৈন্য সৈন্যই সই। যেখানে হোক, যেকেউ হোক—আমেরিকান, চীনেম্যান, নিগ্রো যেই হোক, কারো না কারো চক্ষুকর্ণে এই পরমাশ্চর্য জিনিস লাগুক এই আমার আকাঙ্ক্ষা।
ভেবে দেখি। আমার ধারণা ছিল আদর্শমূলক হবে তোমার বইটা—যার ছত্রে ছত্রে ভারতের নিজস্ব ভাবধারা তর তর বেগে বয়ে গেছে—এমন কিছু। বিদেশী সৈনিকদের কাছে তা ছাড়া কী আমরা দেখাতে পারি? আমাদের কাছে আর কী পাবার ওরা প্রত্যাশা রাখে?
বেশ, আমি এটাকে শুধবে গুরুগম্ভীর বানিয়ে দিচ্ছি। ভারতেব যত মৌলিক ভাবধারা এনে ফেলব—একেবারে মূল উপড়ে যার মূল্য হয় না। উপনিষয়ে থেকেও হ্যাচকা টান দেব, রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীর থেকেও নেব কিছু। তারপর আমাদের বিবেকানন্দ তো পড়েই আছেন। সবার নিয়ে, সব মিলিয়ে একটা জগা-খিচুড়ি পাকাতে কতক্ষণ? তবে আমাকে সময় দিতে হবে। এটা লিখতে ছ হপ্তা লেগেছিল; মাস খানেক অন্ততঃ দিতে হবে আমায়। তবে লেখার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি অনুবাদ করে যেতে পারো।
পাগল! তা হয় না। অত সময় হাতে নেই। আমেরিকান সৈন্যরা কি তোমার নাটকের জন্যে বসে থাকবে এখানে? তারা সবে এসেছে কয়েকদিন থেকেই কোথায় ফের চলে যাবে, তার কিছু ঠিক নেই। কাল থেকেই আমাদের রিহার্সাল শুরু।
তাহলে জানাশোনার মধ্যে যে সব মারাত্মক নাটক রয়েছে বঙ্গে বগী কি চন্দ্রগুপ্ত কি মিসরকুমারী—ওরই একটা নিয়ে লাগিয়ে দাওনা?
অসম্ভব। সত্যিকারের লেখকরা বইয়ের অভিনয়ের জন্য টাকা চেয়ে থাকে—তাদের রয়্যাটি দিতে হয়। পিসিমা দ্বিতীয়বার আমার হৃদয়ে আঘাত হানলেন।
সৈন্যদের জন্যেই হবে যদি গ্যারান্টি দাও তাহলে হয়তো না চাইতেও পারে।
আমি কিছু গ্যারান্টি দিতে রাজি নই। দাঁড়াও না, আগে তো পার্টগুলো কাকে কী দেয়া যায় ঠিক হোক। তারপরেই টের পাবে।
পরদিন প্রভাতে স্থানীয় অভিনয় শিল্পীরা পিসিমার কুটিরে সমবেত হলেন। যে সময়ে নেপথ্যে দাঁড়িয়ে নাট্যকার-সুলভ লজ্জায় আমি লাল হয়ে উঠছি, পিসিমা তাদের কাছে। আমার নাটকটির পরিশ্ম দিতে লেগেছেন। বইটার অখাদ্যতার জন্য যথেষ্ট মার্জনা ভিক্ষা করে অবশেষে বললেনঃ নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। এইটেকেই কোনো রকমে কেটে-হেঁটে খাড়া করতে হবে। নাট্যকার বলেছেন নিজেই সেসব ঠিক-ঠাক করে দেবেন—আজে বাজে সবকিছু বাদ দেবার সাথে সাথে একটা আদর্শমূলক মতবাদও এনে ফেলবে ভরসা দিয়েছেন।
তারপর পিসিমা–তাঁর স্বভাবসুলভ দক্ষতায়–নিজেকেই প্রযোজক, রঙ্গমঞ্চেব কর্তা, অভিনয়-শিক্ষক, সর্বাধ্যক্ষ এবং কার্যকরী-সমিতি নিযুক্ত করে স্বয়ং একাধারে সমস্ত হয়ে উপস্থিত প্রতিভাদের ভেতর থেকে অভিনেতা নির্বাচনে অগ্রসর হলেন।
সমস্তদিন ধরে বিদ্যুৎবেগে কাজ চলল। আমি বইটার হাস্যকর খোসালো অংশ বাদ দিয়ে জিনিসটাকে শাসালো করতে থাকি, পিসিমা সঙ্গে সঙ্গে বিলিতি বাক্যে রূপান্তরিত করেন আর কল্পনা তক্ষুনি তক্ষুনি টাইপ রাইটারে একসাথে একাধিক কপি বানিয়ে চলে। সন্ধ্যের মধ্যে সম্পূর্ণ বইটা দাঁড়িয়ে গেল——হাত-পা-মাথাকাটা কোমরভাঙা কোনো কিছুর পক্ষে যতটা দাঁড়ানো সম্ভব।
নাট্যকাররূপে আমার গৌরবলাভের আশা যখন রইল না, তখন অভিনেতারূপে চেষ্টা দেখলে কেমন হয়? অভিনয়ও আমি করতে পারি, আমার ধারণা ____ পাবেন। কিছু তাঁদের অসাধ্য নয়। আমি একবার এক নাট্যকারকে এক গ্রীনরুমে এক অভিনেত্রীর পা টিপতে দেখেছিলাম–সেটা তখন তিনি অভিনয়ই করছিলেন। কল্পনার কাছে থেকে একটা কপি হাতিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেলাম আমি।
কী! মৎলব কী? জানতে চান পিসিমা।
আমি ভাবছি নায়কের ভূমিকাটা আমিই নেব।
অন্য কিছুর চেষ্টা দ্যাখো। বললেন পিসিমা। স্থানীয় লোকদের উৎসাহিত করাই আমার উদ্দেশ্য–নিজের ঘরের লোকদের না। এটাকে আমি আমার ঘরোয়া ব্যাপার বানাতে রাজি নই। তাছাড়া, তোমাকে সিনসিফটারের কাজে আমার দরকার।
এবারে আমি ভেঙে পড়লাম। নাটকের উরু ভেঙ্গেও আমার গুরুতর হানি হয়নি কিন্তু এবার—নাঃ, এই হচ্ছে উটের বোঝার ওপর খড়ের শেষ আঁটি–খরতর আঘাত। এবং নিজের পিসিমার নির্দয় হাত থেকে। ভাবতেও দুর্বিসহ। একবার এক অ্যামেচারী পালায় সিনসিফটার সেজেছিলাম, ও কাজ যে কতো ঝকমারির তা আমার অজানা না–কাজেই আবার সে পাল্লায় পড়তে হবে ভাবতেই আমি উটমুখো হয়ে উঠি।