পোক্টমাষ্টারের দাঁড়িপাল্লায় শোভমান খর্বাকার একটা খবরের কাগজ দেখা গেল—ত্রিপুরা-বার্তাবহ না কি! এই আকারের একখানা শোভনার হাতেও কালকে না কবে যেন দেখেছিলাম মনে হচ্ছে। আরো দেখলাম—কৌতূহল চরিতার্থ করতে গিয়ে আরো দ্রষ্টব্য দেখা দিলো—উক্ত সাপ্তাহিকের এক কোণে-বড় বড় না হলেও মেজ মেজ হরফে ছাপা রয়েছে—একটি ইস্তাহার!…
বিশেষ সংবাদ। ভারতবর্ষের সবকয়টি ট্রেনিং ক্যাপের সামরিক রিকুটেরা আগামী সপ্তাহে আমাদের পার্বত্য ত্রিপুরায় সম্মিলিত হইতেছেন। শান্তিপূর্ণ মাটিয়ারি অঞ্চলেই তাঁহাদের ছাউনি পড়িবে…
৩. টেলিগ্রামের থেকে চোখ তুলে
কল্পনা টেলিগ্রামের থেকে চোখ তুলে আমার মুখে তাকালো এবং আমার থেকে চোখ নামিয়ে ফের টেলিগ্রামের দিকে।
এক্ষুনি চলে এসো—পিসিমা। বিড় বিড় করলো সেঃ পিসিমা কেন ডেকেছেন আঁচ পাচ্ছে কিছু?
বিশেষ করে ভেবে অবশেষে আমি বলি, গম্ভীর মুখেই বলি—আমার যা মনে হয়—হয়তো খুব অদ্ভুত শোনাবে, তবু এরমকটাও হওয়া সম্ভব—এর মানে হচ্ছে, চলে এসো চটপট। তাই কী?
তোমার মুণ্ডু! কল্পনার মুখঝামটা শোনা যায়? পিসীমার ভালোমন্দ কিছু হওয়া তো সম্ভব নয়—কী বলে?
এক হিসেবে সেকথা সত্যি। শ্রীশ্রীপিসীমা ভালোমন্দের অতীত। অপর পক্ষে, যাঁরা নিরপেক্ষ বিচারক তাঁদের মতে পিসীমার ভালো কিছুই নেই-হতেও পারে না; বরং মন্দ বলতে যাকিছু আছে সমস্তই তাতে বর্তমান। এবং আরো আরো বহুৎ মন্দ তাঁর আবশ্যম্ভাবী। অবশ্যি, এটা দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য মাত্র।
কী করবে ভাবছো? কল্পনা জিজ্ঞেস করে। —যাবে?
ক্ষেপেছো! এই দারুণ বর্ষায় শিলং-এর কথা ভাবতেই আমার হৃৎকম্প হচ্ছে—সেখানে না গিয়েই। ওকথা ভুলে যাও।
এবং আমরা ভুলে গেলাম। সন্ধ্যে পর্যন্তই। ইতিমধ্যে বাংলা মুলুকের টেলিগ্রাফের তার আরেকবার মোড খেয়েছে—আর তার আর্তনাদ আরেকটি খাকি রঙের খামে সন্ধ্যের মুখে আমাদের শান্তিকুঞ্জে ভেসে এসেছে।
জবাব নেই কেন দাঁড়ি চলে এসো এক্ষুনি দাড়ি নাটকটা এনো দাঁড়ি জরুরী পিসিমা। এতগুলি দাঁডি তারবার্তা থেকে পাওয়া গেল—পিসিমার তারস্বরের সঙ্গে। হাতে স্বর্গ পাওয়ার মতই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পেলাম।
ওঃ! চেঁচিয়ে ওঠে কল্পনা : তাই তো! ঠিকই তো!
য়্যাঁহ?
পিসিমার বিখ্যাত লোকদের সঙ্গে মেলামেশার চিরকেলে বাতিক, ভুলে গেছ? সে মনে করিয়ে দেয়ঃ বোঝা যাচ্ছে, পিসিমার বাড়িতে—মানে, পিসিমা সম্প্রতি কোনো পায়াভারী কাউকে—মানে হোমরা চোমরা কেউ সেখানে অতিথি হয়ে এসেছেন।
এসেছেন তো কী হলো?
কল্পনা আমাকে ঘরের মধ্যে ঠেলে দেয় : বোকো না, যাও। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও গে। নাটকটাও নিয়ে। পিসিমা, কোনো থিয়েটারওয়ালা কি ফি-ডিরেক্টর কাউকে গেরেপ্তার করেছেন, টের পাচ্ছো না?
আমি লাফিয়ে উঠলাম তৎক্ষণাৎ। এরকমটা হলে অবশ্যি আলাদা কথা—এবং তাহলে এপর্যন্ত পিসিমা সম্বন্ধে যা বক্রোক্তি করেছি তার প্রত্যেকটি কথা প্রত্যাহার করতে আমি প্রস্তুত। পিসিমা যদি কল-কৌশলে কোনো হোমরা চোমরাকে পাকডে আমার নাট্যকারু সম্পর্কে থিয়েটার ও সিনেমাজগতের এতাবৎ শোচনীয় মন্তব্য পালটে দিতে পারেন, তাহলে এত খরচ করে কষ্ট স্বীকার করে শিলং যাওয়ার মজুরি পুষিয়ে যায়—নিঃসন্দেহেই।
শিলংয়ের সুশোভন দৃশ্যপট দেখতে দেখতে বিকেল নাগাদ তো পিসিমার আবাসে পোঁছানো গেল। দরজায় পোঁছে, নিজেদের আমরা টান করে নিলাম, কৃষ্টিসুলভ দৃষ্টি এবং কৃচ্ছসাধ্য উজ্জ্বল এক প্রস্থ হাসি উভয়ের মুখে জোর করে ফুটিয়ে তুললাম। বৈকালিক। চা-পানে নিযুক্ত হোমরাও চোমরাও লোকের সামনে ঝোড়ো কাকের মত অনাথ আতুররূপে উপস্থিত হয়ে তো কোনো লাভ নেই।
কিন্তু হোমরাও চোমরাও কেউ ছিল না সেখানে। আরো খারাপ, চায়ের কোনো ব্যবস্থাও। তবু পিসিমা সেখানে ছিলেন। এবং দর্শনমাত্র প্রথম কথাই তিনি পাড়লেন?
নাটকটা এনেছো?
নিশ্চয়, কিন্তু কোথায় তোমার—
পড়ো, শুনি আগাগোড়া। হুকুম হোলো তার।–পড়ে শোনাও আগে।
অগত্যা, আমি পড়ে গেলুম-মায়, প্রস্তাবনা সমেত তিন অঙ্কে সম্পূর্ণ, অসংখ্য দৃশ্য-উপদৃশ্যে বিভক্ত, পেল্লায় নাটকটা এক নিঃশ্বাসে আগাগোড়া পড়ে যেতে হলো।
বইটা পড়বার সময়ে দু একটা চাপা হাসি আমার কানে এসেছিল—পিসিমার হাসিই-তৎক্ষণাৎ আমি চোখ তুলে তাকিয়েছি। কিন্তু পিসিমার বক্র হাস্য নজরে ঠেকতেই ব্রীড়ায় চোখ নামিয়ে নিতে হয়েছে।
অবশেষে নাটকের যবনিকা পড়লো। কষ্টদায়ক একটা থমথমে ভাব বিরাজ করতে থাকলো ঘরের মধ্যে। এই নিস্তব্ধতা স্বভাবতই যে কোনো নাট্যকারের পক্ষে নিরুৎসাহজনক।
আমি ভেবেছিলাম নাটকটা খুব গুরুগম্ভীর হবে। পিসিমাই স্তব্ধতা ভাঙলেন? আদর্শমূলক কিছু হবে। তা নয়। নেহাতই হালকা ব্যাপার।
আমি ইচ্ছে করেই এটা হাস্যকর করেছি। বললাম আমি : যাতে মানুষ তার এত দুঃখের মধ্যেও একটু হাসতে পায়, হালকা হতে পারে, স্ফূর্তি পায় খানিক—সেই জন্যেই।
তাতে লাভ?
মনের আনন্দে লিখেছি—অপরকে আনন্দ দেবার জন্যেই! লাভালাভ খতিয়ে টাকার জন্য লেখা নয়তো।
সেকথা ভালো।
পিসীমার কণ্ঠস্বরে এবার যেন একটু আশ্বাস মিললো। মনে হোলো বইটা নিতান্তই ব্যর্থ হবে না। বাংলার সুরুচিসম্মত আর কৃষ্টিসম্পন্ন দর্শকদের পাতে পড়বে হয়ত বা। এবং অর্থভাগ্য তেমন যদি নাও থাকে, যশের ভাগ জুটলেই আমার যথেষ্ট।