বেশ, মেজর আমি না-হয় নাই হলুম, তুমি যে মাইনর তার তো আর ভুল নেই। তোমার ভালমন্দের দায়িত্ব এখন আমাদের তো।
কক্ষনো না। মেজরের মেয়ে কক্ষনো মাইনর হতে পারে না।
ক্ষুধারকণ্ঠে ও বলে। সেই ধারালো ক্ষুরের সামনে গলা বাড়াবো—এমন সাহস আমার হয় না। দরজা দিয়ে গলে আসি ফের।
সেদিন বিকেলে ড্রইংরুমে বসে স্বরলিপির বইটার পা ওল্টাচ্ছি, এমন সময় শোভনা থাকি পরিচ্ছদের অন্তর্গত একটি ভাবী মেজরের সাথে ঘরের মধ্যে সঞ্চারিত হলো।
নমস্কার। আমাকে সম্মুখে দেখে সেই খাকি পরিচ্ছদ সশব্দে অ্যাটেন্ হয়ে দাঁড়ালেন।
ডিট্টো। শুকষ্ঠে প্রতিনমস্কার জানালাম।
এই, আজ্ঞে—আমার বিজাতীয় সম্ভাষণে যুবকটি যেন একটু দমেই গেল।—এধার দিয়ে যাচ্ছিলাম, শোভনা দেবী দয়া করে আমাকে চা-পানের জন্য ডাকলেন।
ইনি—ইনি হাবিলদার পট্টনায়ক। শোভনা দেবী দয়া করে সামরিক শোভাটির পরিচয় প্রদান করেন।
ও তাই নাকি? আমি ভয়ানক খুশি হয়ে উঠি: তোমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ হলে এত আনন্দ হয় আমার কী বলবো? আপনিই শ্রীমান পট্টনায়ক? আপনাদের অনেকগুলি নায়কের সঙ্গেই ইতিমধ্যে আমার জানালোনা হয়েছে—অবশ্যি, আপনাদের শ্ৰীমতী শোভনা দেবীর সৌজন্যেই-বলাই বাহুল্য। এই যেমন, মিঃ চট্টরাজ, ক্যাপটেন চাই, কর্ণেল খোন্দকার, শ্ৰীযুত বাজপেয়ী কিম্বা বাজপাই যাই বলুন-লেফটেনেন্ট লাট্ট নারায়ণ—সিপাহি বিল সিং তেওয়ারি—ইত্যাদি ইত্যাদি। সত্যি, এমন প্লিজিং কোম্পানি কী বলবযারপরনাই।
আঁ—আজ্ঞে—? বেচারী থতমত খায়। আহত নেত্রে শোনার দিকে চেয়ে থাকে। আর শোভনা? শোভনার দিকে আমি চাইতেই পারি না। মেজর শোভার দুচোখে দুই বেয়নেট।
আমি—আমি তাহলে এখন আসি। ঢোক গিলে যুবকটি বলে।
না না, এখনই যাবেন কী? আমি আরো উৎসাহিত হই : এখনো তো চারটে বাজেনি। চারটের মধ্যেই আপনার সহযোগীদের সবার দেখা পাবেন—এখানেই পাবেন। মিষ্টার বেঙ্কটরম, মিষ্টার ভেঙ্কটল্লা এবং মিঃ বালাজী বাজীরাও—ঐতিহাসিক ক্রমানুগতিতে নম্বর তিন কি চার কী হবেন তা বলতে পারব না—একে একে সবাই আসবেন। তৃতীয় বালাজী বাজীরাও তো চারটে বাজলেই চায়ের ঝোঁকে এসে পড়েন।
পট্টনায়ক কী যেন বলবার চেষ্টা করেন, তাঁর গলার ভেতর ঘড়ঘড় করে ওঠে-ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চারটে বাজতে দেড় মিনিট দেরি আছে টের পান-তখন, সেই ঘর্ঘর-ধ্বনির সাথেই দ্রুত বিদায়বাণী উচ্চারণ করে—শুভসন্ধ্যা জানিয়ে—-তিনটে সোফা টপকে—পরপর পার হয়ে——টিপয় টেবিল দেরাজ পরম্পরা জানালার ধারে গিয়ে পৌঁছন। তারপরে আর একটুও ইতস্ততঃ না করে বেড়ালদের যাতায়াতের সেই রাজপথকেই সোজাপথ ভেবে তার ফাঁক দিয়ে এক লাফে নেপথ্যে অন্তর্হিত হন। এক মুহূর্ত আর দাঁড়ান না।…
আজকের গাড়িতেই আমরা কলকাতা ছাড়চি। কল্পনাকে গিয়ে বললাম।
আঁ? সে চমকে ওঠে।
হ্যাঁ। না গেলে কী সর্বনাশ হবে তার কিছু তুমি বুঝতে পারছো? এহেন সামরিক আবহাওয়ায়–এই যুদ্ধকালীন কলকাতায় শোতনাকে রাখার মত বিপজ্জনক আর কিছু হতে পারে না। এই ছোঁয়াচে আওতা থেকে দূরে নিয়ে ওকে বাঁচাতে হবে। ভেবে দ্যাখো—পরের কন্যাদায় আমরা নিজের ঘাড়ে নিয়েছি।
কিন্তু যাবো কোথায়? কল্পনা জিজ্ঞেস করে।
সুদূর কোনো গণ্ডগ্রামে। কেন, মাটিয়ারিতে গেলে কেমন হয়?
মাটিয়ারি?
মাটিয়ারির নামে কল্পনা কেঁপে ওঠে—তার কল্পনাও বুঝি ছাড়িয়ে যায়। এক বন্ধুর আমন্ত্রণে একবার সেখানে আমরা গেলাম। গণ্ডগ্রামের মধ্যে অপোগণ্ড যদি কিছু থাকে তো সে মাটিয়ারি। গণ্ডগোলের গ-পযও নাস্তি! মানুষ এবং অমানুষ-মোট জড়িয়ে সেখানে মাটি ছাড়া আর কিছুই নেই। জনপ্রাণী কাউকে প্রাণীজন বলে বোধ হয় না। জীবনের লক্ষণ কেবল দুটি দেখেছিলাম সেখানে—মহাস্থবির হাড়পাঁজরা-সার ঝরঝরে গাঁয়ের গা ঘেঁসে ঝিরঝিরে এক নদী—আর–আরেকজন—লঝঝড় এক ডাকহরকরা। এই দুইজনাই প্রাণের চাঞ্চল্য পরিস্ফুট করতে যা একটু ছুটোছুটি করত—এছাড়া আর কোথাও একটুখানি বাড়াবাড়ি ছিল না।
মাটিয়ারিতে এসে দিন সাতেক শোভনা মনমরা হয়ে থাকলো। অতগুলো ভাব মাটি করে—অমন মহা মহা প্রাদুর্ভাবের মহামারি থেকে এখানকার একঘেয়ে আড়ির মধ্যে এসে—মন ভারী হওয়া বিচিত্র নয়। কিন্তু ক্রমেই ওর আগ্রহ দেখা দিলো—ফেরারী উৎসাহ যেন ফিরে এলো আবার। মাটিয়ারি গ্রামের তৃতীয় জীবনের লক্ষণ আমরা প্রত্যক্ষ করলাম।
এমনকি, একদিন সে মুখ ফুটে বলেই ফেলল? নাঃ, জায়গাটা তত খারাপ না। যতটা মনে হয়েছিলো তা নয়। এমন স্থানেরও সম্ভাবনা আছে। বেশ সম্ভবনা আছে।
পার্বত্য ত্রিপুরার কুক্ষিগত এই দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয়) শান্তিনিকেতনের আবার কী সম্ভাবনা সে দেখেছে সেই জানে! নৈঋত কোণ অবধি চারধার বেশ করে খুঁটিয়ে দেখেও অশান্তির কোনো খুঁটিনাটি আমার নজরে পড়লো না।
যাক তবু যে এখানকার মাটিতে ওর মন বসেছে সেই ঢের। বনহরিণীসুলভ ওর মনোহারিণী লীলা আবার আমাদের চোখে পড়ছে, এই আমাদের সৌভাগ্য।
বিধি ডাগর আঁখি
যদি দিয়েছিলো
সে কি আমার পানে
ভুলে পড়িবে না?…
সেদিনকার স্বরলিপির পাতায় দেখা গানের এই কলিটা নিজের মনে গুন গুনিয়ে গাঁয়ের পথে বেরিয়ে পড়লাম…।
পোষ্টাফিসের অভিসারেই বেরিয়েছিলাম…
পোষ্টাফিসের নামান্তর-স্থানীয় মুদি ওরফে পোষ্টমাষ্টারের ভাঙা কেরোসিন কাঠের বাক্স থেকে হাতড়ে মাতড়ে যদি পাওয়া যায়—তেলচটা একখানা পোষ্টকার্ড বাগিয়ে আনার চেষ্টা করব।