কিন্তু জোড়া গেঁথে যদি আমরা পাশের ঘরে পাঠাই তাহলে তা, কখন ফিরবে তার কি কিছু ইয়ত্তা আছে? কোন ঘরে শেষ পর্যন্ত তাদের পাওয়া যাবে তাও বলা মুস্কিল। এমন কি,–বলতে গিয়ে আমি চেপে যাই।
মুস্কিল কিসের? ও জিজ্ঞেস করে।
মানে, আদৌ ফিরবে কিনা, কোনো ঘরেই পাওয়া যাবে কি না তাই বা কে জানে! আমার উপসংহার। আত্মীয়রা এবং আত্মীয়তা স্বভাবতই আমার কাছে রহস্যময়।
তাহলে—তাহলে না হয় এক একজন করেই ছাড়া যাবে। কল্পনা বলে : তারপরে আর কি, তালিকার ছটা আইটেমের মধ্যে যেগুলো বেশ ব্যয়সাধ্য সেগুলো হেঁটে বাদ দিলেই হবে। তখন খুব সহজেই আমাদের দেবার জিনিস আমরা বেছে নিতে পারবো।
যেমন ধরা যাক— আবার আমার উদাহরণের প্রতি টান : আমাদের মামাবাবু চান–
১। ল্যান্ড মাস্টার গাড়ি,
২। বিমানপথে ভূ-ভারত-ভ্রমণ,
৩। বালিগঞ্জে বাড়ি,
৪। বাঘ শিকার করতে,
৫। কোনো বিশেষ চিত্রতারকার সৌখ্য, এবং ৬। ভালো এক কৌটো সিগ্রেট, তাহলে তিনি খালি সিগ্রেটই উপহার পাবেন। কেমন, এই তো?
ঠিক তাই। তালিকার কোথাও না কোথাও তার মনের তাল পাওয়া যাবেই। যে তাল আমাদের মনের মানের সঙ্গে খাপ খাবে।
কনার ইচ্ছামতো, অভিলাষ-আসর জমানো গেল। তালিকাও পাওয়া গেল যথারীতি। কিন্তু পেয়ে দেখা গেল, না পেলেই ছিল ভালো! আমাদের আত্মীয়দের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কাঞ্চনজঙ্ঘাকেও হার মানায়। মানুষকে আত্মহারা করে দেয়। মুক্তকচ্ছ করে মহাপ্রস্থানের পথে টানতে থাকে।
মঞ্জু, তার ইচ্ছা-তালিকায় চেয়েছে দেখলাম—এক, একখানা বাড়ি; সিমলাশৈলে হলেই ভালো হয়, নেহাতপক্ষে সিমলা স্ট্রিটে হলেও ক্ষতি নেই; দুই, অভিনেত্রী জীবন (বলাবাহুল্য, চিত্রনায়িকারূপে); তিন, কাশ্মীর বেড়ানো; চার, লাখখানেক টাকা (অনেক কমসম করেই); পাঁচ, নতুন ডিজাইনের ডজন খানেক শাড়ি; আর ছ নম্বরে, দেশবিখ্যাত স্বামী।
তালিকাটি আগাগোড়া চষে গেলাম—ওর কটুকষায় উপসমাপ্তি অবধি। ওর শেষ প্রার্থনাটা আমার দ্বারা পূর্ণ হবার নয়। খোঁচাটা লাগলো। কিন্তু আমার অভাবে, ওর এই অপূরণীয় ক্ষতি কোনোদিন পূর্ণ হবে কিনা কে জানে।
সিল্কের রুমাল। সাব্যস্ত করল কল্পনা।
সিল্কের রুমালের কথা কোথাও কিন্তু নেই ওর। আমি আপত্তি করি।
তাই চেয়েছে পাকে প্রকারে। কল্পনা গর্জে ওঠে: ওকরম চালচলনে সিল্কের রুমাল হলে মানায় না। উঁচু নজরটা দেখেছ?
আহা, তোমারই তো বোন— আমি বলতে যাই।
আমাদের আজে-বাজে স্বামী হলে চলে যায়, আর ওর চাই কি না— কল্পনা গজরাতে থাকে।
সত্যি। সন্দেশ-বিখ্যাত স্বামী চাইলেও না হয় একটা গতি করতে পারা যেত। কিন্তু ভীম নাগও এহেন নাগিনীর বিষাক্ত নিঃশ্বাসের আওতায় আসতে চাইবেন কি না ভাবতে গিয়ে আমায় থামতে হয়।
আমাদের মামাবাবুর চাহিদাটা একটু রাজনৈতিক। তিনি কলকাতার মেয়র হতে চেয়েছেন। মন্ত্রীমণ্ডলীর মধ্যে একজন হতেও তার অনিচ্ছা নেই। ওই দুইয়ের একটাও যদি ঘটে যায় তাহলে কলকাতায় বাড়ি পাবার আকাঙ্ক্ষাকে তিনি তিন নম্বরের মধ্যে আনতেই রাজি নন; কেননা পূর্বোক্তরূপ বাড়াবাড়ি তার ভাগ্যে ঘটলে ঘরবাড়ি ইত্যাদি অবলীলাক্রমে আপনা থেকেই এসে যাবে। চতুর্থতঃ, রাজপ্রমুখ উপাধি লাভ করা। রাজত্ব থাকলে যে রাজপ্রমুখহওয়া যায় না একথা মানতে তিনি নারাজ। পঞ্চমত, বাংলাদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া, নিতান্ত না হতে পারলে তার বদলে—সেইটাই তাঁর শেষ ইচ্ছা—খাদ্য মন্ত্রীর দপ্তরে কোনো পদ (সেজন্য যেকোনো অপদস্থতা মেনে নিতে প্রস্তুত আছেন)।
তাঁকে এক কৌটো সিগ্রেট দিলেই হবে, আমরা বিবেচনা করে দেখলুম। কেননা যন্দুর অবধি দৃষ্টি যায়, তাঁর রাজনৈতিক জীবন ধোঁয়াতেই পরিসমাপ্ত হতে বাধ্য, দেখা গেল।
সৌম্য চেয়েছে (১) একটা মোটর সাইকেল, (২) কোডাকের ক্যামেরা, (৩) রাণিং শু, (৪) সাঁতার কাটবার নিজস্ব একটা পুকুর, (৫) একখানা ভালো ডিটেকটিভ বই, (৬) আস্ত একটা এরোপ্লেন।
ওর ইচ্ছামত, একখানা গোয়েন্দাকাহিনী ওকে দিতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হোলো না। ব্ল্যাক গার্লস সার্চ ফর গডবার্নার্ড শর সেই বইখানা পড়ে ছিল—দিয়ে দেয়া গেল।
রঞ্জনের অভিলাষ একটু বিচিত্র রকমের। বন্দুক, পিস্তল, রিভলবার, হাতবোমা ইত্যাদি মারাত্মক যত অস্ত্রশস্ত্রেই তার অভিরুচি।
এছাড়াও বঞ্জনের একটা পুনশ্চ ছিলো, একশো গজ লাল রঙের শালু, কেন যে তা কে জানে। তার এই লালসার মধ্যে একটু কমরেড-কমরেড-গন্ধ মিলতে লাগল। লাল নিশান উড়িয়ে কেরলের দিকে ধাওয়া করবে কি না ওই জানে। আন্দাজটা ব্যক্ত করলাম।
কিন্তু এই বাজারে একখানা রুমাল কেনা দায়, কালোবাজারে আর লালবাজারে রেষারেষি,–এর মাঝে শালু আমি পাই কোথায়?
তাও আবার একশো গজ। কল্পনা মুখ বাঁকালো।
একশো গজের কথা থাক, একটা ইঁদুরের পরবার মতো কাপড় কেনার পয়সা জোটে। আমি বল্লাম : অবশ্যি এক কাজ করলে হয়। ওর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। আমাদের মঞ্জুর সঙ্গেই–
আর মঞ্জুকে একটা শালুর ব্লাউজ দিলেই চলে যাবে।
কল্পনাই উভয় সঙ্কটের সমাধান করে দেয়।
লাল শালুর ব্লাউজ। এক গজেই হবে তো? সায় দিই আমি? তাহলে একরকম একশ গজই দেয়া হবে। মঞ্জু আমাদের একাই একশ।
২. ভালোবাসিলে ভালো যারে বাসিতে হয়
বৃন্দাবনে কুরুক্ষেত্র কিম্বা কুরুক্ষেত্রে বৃন্দাবন, চুলচেরা বিচারে বলা কঠিন, কিন্তু তাহলেও অঘটনটার ল্যাজামুড়ো মিলিয়ে সম্রাট শালীবাহনের তেমন ভালো লাগবার কথা নয়। এবং লাগছিলও না। সে যুগের সম্রাট এ-অবস্থায় পড়লে কী করতেন কে জানে, কিন্তু একালে তার দরাজ সংস্করণ হয়েও এই লঘুভার বহনে যেন আমার ঘাড় ভাঙছিল। সত্যি, ব্যাপারটা যেন সহনশক্তির এলাকা ছাড়িয়ে যায়…