দোর গোড়াতেই কল্পনার সঙ্গে দেখা।
উঃ, আজ খুব একটা ফাড়া গ্যাছে। কল্পনা উচ্ছ্বসিত স্বরে বলে? বলছি, ভেতরে চলো।
ফাড়া? য়্যা? বলল কী?
যখন ছবি দেখে আমরা বেরুলুম, তুমি বল্লে না যে, আমার হাত ধরো,তোমার মনে নেই?
আছে বইকি। আমাকে স্বীকাব করতে হয়।
আমি ধরেও ছিলাম, কিন্তু অন্ধকাবে প্রত্যেক হাতই প্রায় এক রকম। আমি তোমার হাত মনে করে আরেক জনের-লোকটা কিন্তু ভারী রোমান্টিক, ই বলো। বিয়ের আগে তুমি যেমনটা ছিলে, অনেকটা তেমনি আর কি।
বুঝেছি, অন্ধকারের সুযোগে বেহাত হয়ে আমি কঠোর ভাষায় আরেক হাত নিইঃ তুমি বেশ একটু পরস্মৈপদী ফুর্তি লুটে নিয়েছ। …ভালো করোনি। ছিঃ।
বাঃ, কী করে জানব আমি? আমি ভেবেছিলাম, তুমিই। অনেকটা তোমার মতই গলা। অবশ্যি, কেমন একটু ক্ষ্যাপা মনে হচ্ছিল, তবুও যতক্ষণ না লোকটা আমায় চুমু খেল আমি সন্দেহই করতে পারিনি। তারপরই তো আমি টের পেলুম যে তুমি নয়। তুমি কখনো চুমু খাবার কথা ভাবতেই পারে না। নিজের বউকে কি কেউ চুমু খায়—মানে, বিয়ের এই এতদিন পরে?
যাকগে, যেতে দাও, বলে কথাটা আমি উড়িয়ে দিই: যে কাজটা ফেলে রেখে গেছি মনে আছে? কাল সকালেই তার ব্যবস্থা করতে হবে। পূজো তো এসে পড়ল। কাকে কী উপহার দেওয়া যায় আজ রাত্রেই তার ফয়সলা করার দরকার।
কাল সকালে আমার সময় হবে না। আমি জানাই। এবার টাকাকড়ির যা টান-আত্মীয়তার টানাটানিটা একটু কমালে কী হয়? এবার পূজোয় ধরে কাউকে কিছু যদি না দিই?
এবারে শারদীয়ায় কাকে কী তত্ত্ব দেয়া যায়, সেই সমস্যায় পড়া গেছল। সারা বছর কেউ কারো তত্ত্ব নেব না এবং পূজোর সময় সে-সমস্তর প্রতিশোধ নেব, এই আমাদের চিরাচরিত পারিবারিক প্রথা। পুজোর তত্ত্বকথা। এই দারুণ দুবৎসরে উক্ত প্রথার কোনোরূপ ইতরবিশেষ করা যায় কিনা ঠাওর করছিলাম।
উঁহু। তা হয় না। ঘাড় নাড়ল কল্পনা। পরিবারের কাছ থেকেই বাধা এল প্রথম।
তাহলে উপহার-দ্রব্য নিয়েও মাথা ঘামানোর দরকার নেই। আমি বলি : মঞ্জুকে একটা সিল্কের রুমাল, মামাকে এক কৌটো সিগ্রেট, সৌম্যকে একখানা ভালো বই, আমারই বই একখানা, আর রঞ্জনকে একটি ছড়ি—এই দেয়া যাক। এই—এই দিয়েই এবারকার হাঙ্গামা চুকিয়ে দিলে কী ক্ষতি?
ক্ষতি নেই? কল্পনা জিজ্ঞেস করে।
খতিয়ে দেখলে ক্ষতিই অবশ্যি। উপহারের ছড়াছড়ি করার আমিও পক্ষপাতী নই। কিন্তু তুমি আবার বলছো–
আমি মোটেই ওই দিতে বলছিনে। কল্পনা বাধা দিয়ে বলে? উপযুক্ত উপহার কী দেয়া যায় তাই আমি ভেবে দেখতে বলেছি।
ভেবে দেখতে আমি নারাজ নই। আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমার কেমন ভয় হচ্ছে যে ভাবতে গেলেই আরো বেশি খরচের ধাক্কায় পড়ে যাব।
উপহার তো দিতেই হবে। কিন্তু তা যাতে দেবার মতো হয় তা কি ভাবতে হবে? আহা, কে যে কী চায়, সেইটে যদি কোনো উপায়ে জানা যেত—
রক্ষে করো। আমরা বাঞ্ছাকল্পতরু হতে পারব না। আমি ককিয়ে উঠি।
কল্পতরু না হই, তাদের ইচ্ছার একটুও তো পুরণ করতে পারি। চেষ্টা করলে করা যায় না কি?
একটুখানির মধ্যে নিজেদের ইচ্ছা সীমাবদ্ধ রাখার মানু; কিনা তারা? আত্মীয়দের ভালোমতই আমার জানা আছে—চিনতে আর বাকী নেই। তাদের মনের মধ্যে হানা দিতে গিয়ে
সোজাসুজি তাদের জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছি না কি? আমার বাপের বাড়িতে এরকম ব্যাপারে কী করা হয়ে থাকে জানো? জিজ্ঞেস করে কল্পনা।
কল্পনার পিত্রালয়ের রহস্য আমার কল্পনাতীত। আমি ঘাড় নেড়ে আমার অজ্ঞতা জানাই। উপহারের স্থলে সেখানে প্রহার দেওয়া হয় কি না, তাই ওদের পৈতৃক পদ্ধতি কি না, জানবার আমার কৌতূহ হয়।
ইচ্ছাময়ের লীলা বলে একরকমের খেলা আমরা খেলি। পূজোর কিছুদিন আগে আত্মীয়বন্ধুদের ডেকে একটা পার্টি দিই। সেই আসরেই খেলাটা ফাদা হয়। কার কী কী জিনিস পাবার কামনা, প্রত্যেককে তার তালিকা বানাতে বলা হয়। তারপরে যে কী য় আমার ঠিক মনে পড়ছে না।
দিস্তা দিস্তা কাগজ আনার দরকার পড়ে বোধ হয়? আমি অনুমান করি।–তাহলে বলো, রিমখানেক কাগজের জন্যে ভোলানাথ দত্তে অর্ডার দেয়া যাক?
বাজে বোকো না। ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে ও মনে হচ্ছে দুটা ইচ্ছের মধ্যেই তালিকা সম্পূর্ণ করতে বলা হোতো। আমরাও ওদের নেমন্তন্নের আসরে ডেকে এনে তাই বলবো। তাহলেই ল্যাঠা চুকে যাবে। তাহলেই তো ফর্দ আর বাড়তে পাবে না।
বেশ, তারপর?
তারপরে, ইচ্ছা পুরণের জন্য একজন করে আসর থেকে উঠে পাশের ঘরে যাবে—
যেমন ধরা যাক মঞ্জুলিকা। আমি উদাহরণের পক্ষপাতী। দৃষ্টান্তের স্বরূপছাড়া কোনো বস্তু প্রত্যক্ষ করা—সম্যকরূপে হৃদয়ঙ্গম করা আমার পক্ষে সুকঠিন।
বেশ, মঙুই হলো না হয়।
তাহলে আরেকজনকেও তো যেতে হবে তার সঙ্গে। বলি আমি।
কেন? আরেকজন কেন?
বাঃ, আর কেউ না গেলে তার ইচ্ছা পূর্ণ হবে কী করে?
এ তোমার–যতো—ইয়ের খেলা নয়। কল্পনা ঝাঁঝিয়ে ওঠে: একেবারে আলাদা জিনিস।
কিন্তু মঞ্জুর মন যা চায় তাইতো যোগাতে হবে? মনে মনে সর্বদাই সে পরমুখাপেক্ষী। তার মুখ্য ইচ্ছে হলো—
চুমু খাবার? তুমিই ভালো জানো! কিন্তু সেসব এখানে চলবে না।
তাহলে সেরকম নিরামিষ ইচ্ছাপুরণে মঞ্জুর বিশেষ উৎসাহ হবে বলে মনে হয় না। আমিও জানাতে বাধ্য হই।
হলো বয়েই গেল! আমাদের তালিকা পাওয়া নিয়ে কথা। তাদের মনের ইচ্ছাটা শুধু জানার দরকার। কাগজ পেন্সিল নিয়ে না হয় দুজন করেই পাশের ঘরে যাবে—