কিন্তু মীনাক্ষি যদি ডিমই না পাড়ে—আমি হতবুদ্ধি হই।
তোমাকে কি আর সাধে বোকা বলি! বোকেন বলল আরে না পেড়ে যাবে কোথায়? ওরা কতগিন্নীতে দুবেলা মীনাক্ষির সঙ্গে হানড্রেড ইয়ার্ডস দেবে তো সারা দিন বাগানেই ছাড়া থাকবে মীনাক্ষি। সেইসময়ে কোনো ফাঁকে বাগানের কোথাও একটা ডিম ফেলে দিয়ে আসার মামলা। সে ভার আমার উপর থাকলো। বুঝলে এবার?
বুঝলাম বই কি! নাঃ, বোকেন তার নামের দারুণ অমর্যাদা করছে—ওইসূত্রে সেই কথাটাও আরো বেশি বুঝলাম। সেই সঙ্গে, ওর তুলনায় নিজেকেও নিখুঁতরূপে টের পেলাম এতদিনে।
সপ্তাহ ফুরুতেই যতীনের ওপরে আমাদের নোটিশ পড়ে গেল। মীনাক্ষির পালা তার খতম।
তা—তাতে কী হয়েছে? ও ঘোঁৎ ঘোঁৎ করল : কাল সন্ধ্যেয় আমার বাড়ি তোমাদের নেমন্তন্ন। সেই সময়ে সবাই মিলে ভদ্রভাবে মীনাক্ষির বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
ওষুধ ধরেছে তাহলে। ও একাই মীনাক্ষির অভিভাবক হতে ইচ্ছুক। শুধু মুখরোচক খাদ্যের সঙ্গে সামাজিক ভদ্র মিশিয়ে মীনাক্ষির দরটা একট নামাতে চায় মাত্র—ভেবে এমন হাসি পেল! হায় কাল বাদ পরশু সকাল থেকে ডিম পাড়া যখন বন্ধ হবে, তখন মীনাক্ষি প্লাস আমাদের প্রতি তার এই আদরের পরিণতি কী দাঁড়াবে তাই ভাবি। যাই হোক, সাক্ষ্য ভোজে তো গেলাম আমরা। বোকেন এবং শ্রীমতী বোকেন; আমি আর আমার বুদ্ধিমতী।
সন্ধ্যেটা কাটলো বেশ। ভারতীয় চায়ের সঙ্গে স্বদেশী মাংসের পিঠে—খারাপ কি?
টেবিল থেকে পেয়ালা পিরিচ সরে যেতেই বোকেন খুকখুক করে কাশল। ব্যাস কাশি নয়, ভদ্র কাশি, ভদ্রভাবে আলোচনা শুরু করার পূর্বাভাস।
আচ্ছা, এইবার আমরা মীনাক্ষির ভবিষ্যৎ নিয়ে—আরম্ভ করল বোকেন।
শুনে যতীনের শ্রীমতী তো হেসেই কুটোপাটি। যতীনও একটু হাসল, যৎসামান্য, সচরাচর বুদ্ধমূর্তির আননে যে ধরনের রহস্যময় হাসি দেখা যায়।
তোমাদের বলতে দুঃখ হচ্ছে, কিন্তু না জানিয়েও উপায় নেই। বলল যতীন: বেচারী মীনাক্ষির কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
য়্যাঁ?–বোকেনের চোয়াল ঝুলে পড়ে।
আমাদের ঈষৎ ভুল হয়েছিল—এমন কিছু না—এই লাক্ষণিক ভুল। যতীন তেমনি অমায়িক : কিন্তু মীনাক্ষি যেদিন আমার হাতে এল, সেইদিনই কলকাতা থেকে আমার শ্যালক এলেন–তিনি ভেটারনারি ডাক্তার। দেখবামাত্রই মীনাক্ষির অবস্থা তিনি ধরতে পারলেন। তখনি সব পরিষ্কার হয়ে গেল।
কী পরিষ্কার হলো, শুনি? শুনে আমিও একটু গরম হই। আসল কথার পাশ কাটাবার এই চাল আমার ভালো লাগে না।
জানা গেল যে—বলতে দ্বিধা করল না যতীন মীনাক্ষি আসলে হচ্ছে মীনাক্ষ। এই তথ্যের গুঢ়তা গাঢ় হয়ে যতই আমাদের মর্মে প্রবেশ করে ততই তার মর্মান্তিক তীক্ষতা আমরা টের পাই।
ডিম পাড়া তার ক্ষমতার বাইরে। যতীন-গিন্নি কোন রকমে একটুখানির জন্য হাস্যসম্বরণ করে আমাদের আলোচনায় এই মন্তব্যটুকু যোগ করতে পারলেন। এবং তার পরেই আরেক প্রস্থ হাসি আঁকে পেয়ে বসল আবার!
আমরা আর কোনো কথাটি না বলে নিজের গৃহিণীদের সংগ্রহ করে উঠে পড়লাম। নিঃশব্দেই।
অমায়িক যতীন আর আহ্লাদে আটখানা ওর বৌদরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল আমাদের।
বাগানে পা দিয়ে বোকেন বললে? যাই হোক মীনাক্ষি কোথায়? তাকে দেখছিনে কেন?
মীনাক্ষি শ্ৰীমতী যতীন থেমে থেমে জানালেন : সেই পিঠের মধ্যে ছিল।
সেও অতীতের কথা। এখন পেটের মধ্যে, সেই কথাই বলো! বলল যতীনতোমার বন্য সারসটা বেশ সরস হিল হে। বলে কটাক্ষ করল আমার দিকে।
আমরা আর দাঁড়ালুম না। উদরস্থ মীনাক্ষিকে ধরে আমরা পাঁচ জন আমাদের সোজা পথ ধরলুম।
হ্যাঁ, ভালো কথা। পেছন থেকে হেঁকে বলল যতীন : কদিন ধরে তোমরা যে ডিমগুলো পাঠিয়েছ তার জন্যে ধন্যবাদ। সবগুলো মুরগির ছিল না, কয়েকটা হাঁসের ছোট ডিম ভেজাল দিয়েছিলে; তার মধ্যে, এটা আবার গিন্নী বলছিলেন, একটু পচাই। নাকি! যাকগে, যা বাজার, আর যেরকম মাগ্যি গণ্ডা, আর যেমন দিনকাল পড়েছে তাতে ওই নিয়ে আমরা কোনো বচসা করতে চাইনে।