খাবার সময়ে দেখা গেল মীনাক্ষি অতিশয় অবজ্ঞাভয়ে রেডিয়োর ওপরে বসে রয়েছে। আক্রমণাত্মক কোনো লক্ষণ ওর দেখা গেল না। যতুটা মারাত্মক ভাবা গেছল তা নয়; নিতান্তই নিরীহ একটি বন্য পারাবত! (পারাবত বা যাই হোক!) ক্রমেই দেখি মীনাক্ষি এগিয়ে এসে আমাদের থালার থেকে খাবার খুঁটে নিতে লাগল।
দেখতে দেখতে আমরাও মীনাক্ষির আসক্ত হয়ে পড়লাম। দ্বিতীয় দিনেই অদ্বিতীয় পাখিরূপে আমাদের জীবনে কায়েম হলো। একটা বুনো সারস (অথবা বালিহাঁস যাই হোক)–যদিও কিঞ্চিৎ মনমরা—তবু গার্হস্থ্য জীব হিসাবে নেহাত মন্দ না। আর যাই হোক, যখন তখন ঘেউ ঘেউ বা ম্যাও ম্যাও নেই, কাউকে ধরে কামড়াবে না, কিংবা পাড়াপড়শীর বাড়ি গিয়ে চুরি করে দুধ মেরে আসবে না। পাড়াতুত গণ্ডগোল ল্যাজে বেঁধে আনবে না। একটা কক্ষকে আওয়াজ আছে বটে কিন্তু বকবক কম করে। তেমন বক্তা নয়, গানের আপদ নেই, শ্লোগানের বালাইও না।
পাখিটার আমরা প্রেমেই পড়ে গেলাম, বলতে কি! আমাদের পোষ্যকন্যারূপে ওকে গ্রহণ করারও প্রায় মনস্থ করে বসেছি এমন সময়ে বোকেন আর যতীনেব তরফ থেকে বাধা এল।
বোকেন এসে বললে : বাঃ বাবা! খাসা চালাচ্ছো! দিব্যি একটা খরচ বাঁচিয়ে ফেল্লে! বেশ বেশ বেশ!
ডিমের ভাবনা রইলো না। মন্দ কি। যতীন যোগ দিল সেই সঙ্গে।
তুখোর ছেলে! তবে একটু চশমখোর, এই যা! বোকেনের বক্র কটাক্ষ।
তোমরা বল কী? আমি আকাশ থেকে পড়ি।
বলব আর কী! ভাগ্যবানের ডিম ভগবানে যোগায়। তবে কথাটা এই, অপরের সম্পত্তি থেকে যোগানটা আসছে এই যা!
ডিম? আমার চমক লাগে : তোমাদের কি ধারণা যে–
আরে না না! বোকেনের ঠাট্টার সুর : তুমি কি আর ডিমের লোভে-কে বলে! তোমার দাতব্য অতিথশালায় গৃহহীন বন্য কুক্কুটরা এলে অমনিই আশ্রয় পায়।
গার্হস্থ চিড়িয়াখানা বলো। বলল যতীন। এদের দুজনকেই বা বাদ দিচ্ছ কেন?
এই রকম দিনের পর দিন ওদের কচকচি শুনতে হয়, অথচ মীনাক্ষি এদিকে একদিনও একটা ডিম পাড়েনি। ডিম তো পাড়েনি, তার ওপরে কদিন থেকে এমন মেজাজ দেখাতে আরম্ভ করেছে যে আমরা আর ওকে তালা দিয়ে রাখতে চাই না বরং তালাক দিতে পারলেই বাঁচি। এমন স্বার্থপর আত্মসর্বস্ব একগুয়ে পাখি এর আগে আর আমার নজরে পড়েনি—মনুষ্যত্ব দূরে থাক, পক্ষীত্বের লেশমাত্রও ওর নেই।
আজকেও ডিম পেড়েছে তো? এই প্রশ্ন মুখেকরে একদা প্রভাতে যেইনা বোকেনের প্রাদুর্ভাব, অমনি না আমি অম্লানবদনে মীনাক্ষিকে ওর করকমলে সম্প্রদান করে দিয়েছি। যতীনকে সাক্ষী করে।
এবং গদগদ কণ্ঠে বলতেও দ্বিধা করিনিঃ তোমাকে ঘরজামাই করতে পারলুম না, দুঃখ থাকল কিন্তু এই আমার অনুরোধ, আমাদের মীনাক্ষিকে তুমি সুখে রেখো। আর মীনাক্ষি মাকেও বলি, ও তোমার জন্য নিত্য নিয়মিত ডিম পাডুক।
ডিমের ওর বাড়-বাড়ন্ত হোক, সর্বান্তঃকরণে সেই প্রার্থনা করে মীনাক্ষিকে ওর সমভিব্যাহারে দিলাম। এবার ওর সুর বদলায় কিনা দেখা যাক। দিনকয়েক গেল, বোকেনের কোনো বৈলক্ষণ্য দেখা গেল না। তবে কি মীনাক্ষিই তার সুর বদলালো না কি?
কি হে, কিরকম ডিম্বলাভ চলছে? কৌতূহলী হতে হলে আমায়।
প্রত্যেকদিন একটি করে ফাঁক নেই। বোকেন সহাস্যবদন, বন্যকুক্কুট হলে কি হবে, সভ্যতায় অভ্রভেদী!
বলো কী! আমি বিস্মিত না হয়ে পারি না।
তুমি একটা অপদার্থ! কী করে ওদের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় জানো না। রাত দিন রেডিয়োর বাত্ময় বসিয়ে রাখলে কি আর ডিম পাড়ে? গানের দিকে কান থাকলে ডিমের দিকে মন দিতে পারে কখনো? বাগানে দুবেলা দৌড় করাতে হয়। একসারসাইজ দরকার—যেমন আমাদের তেমনি ওদেরও। দুবেলা আমরা ওকে নিয়ে সারা বাগান চষছি——আমি একবেলা, গিন্নী আরেক বেলা। তবে তো ফলছে ডিম!
বোকেন ওদের ঘোড়দৌড় দেখবার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ করল, কিন্তু বন্য পশুপক্ষীর কীর্তিকলাপ আর কী দেখব? তাছাড়া মীনাক্ষির আচরণে প্রাণে বড় ব্যথা পেলাম। ও যে এতটা বিশ্বাসঘাতক আর নিমকহারাম হবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আর অমন পাখির মুখ দ্যাখে?
সমস্ত শুনে যতীন তো খাপ্পা। বাঃ, মীনাক্ষি ওর একলার না কি? ওতো এজমালি সম্পত্তি। কেন, আমাদের কি বাগান নেই, না, আমরা ঘোড়দৌড় করাতে জানিনে? আমাকে যদি ও মীনাক্ষির ভাগ না দেয় তো আমি সোজা আদালতে যাব। আমার সাফ কথা আমি বলে রাখলাম।
ঘোড়দৌড়টা আদালতের দিকে গড়ালে নেহাত মন্দ হয় না, এবং দৌড়বাজিতে ঘোড়ার সংখ্যা যত বাড়ে দৃশ্য হিসাবে ততই আরো দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়ায়। সম্ভাবনাটা বোকেনের কাছে গিয়ে ব্যক্ত করতে চেহারা ও নামের মধ্যে যতটা আশ্বাস ছিল আসলে বোকেন তত বোকা নয় দেখা গেল—সে বলে ওঠে-ঠিক কথাই তো! কালকেই মীনাক্ষি ওর বাগানে যাবে, আসছে হপ্তাটা ওর পালা! মীনাক্ষি এই ভাবে আমাদের সবার হাত ঘুরবে, সেই তো ন্যায্য!
বোকেন তার কথা রাখল। রাত্রি প্রভাত হওয়া মাত্র, মীনাক্ষিকে স্বহস্তে যতীনের হাতে সঁপে দিয়ে এল।
বিকেলের দিকে স্টেশনে আমাদের দেখা হতেই, বোকেন আমাকে আড়ালে ডেকে বললে: ওহে শোননা, তোমার সঙ্গে আর হলনা করতে চাইনে। তুমি ঠিকই বলেছিলে। মীনাক্ষি একদম বাঁজা।
তবে এই যে বলে সেদিন, তোমার প্রক্রিয়ায় বেশ সুফল দেখা দিয়েছে।
কাঁচকলা! তোমাকে যা বলেছিলাম তা স্রেফ প্রচার কার্য! সিনেমা কোম্পানিতে পাবলিসিটি অফিসারের চাকরি করতাম সেটা কেন ভুলে যাচ্ছ? আর, কথাটা রটিয়েছি ওই যতনেটার জন্যেই। মীনাক্ষি ডিম পাড়ছে জানলে ও নগদ টাকায় আমাদের অংশগুলো কিনে নিতে রাজি হবে। ওর যা ডিমের লোভ! দেখো, ঠিক ও মীনাক্ষিকে একচেটে করে নিয়েছে, তুমি দেখে নিয়ে।