অন্ততঃ নিজের জিভে অপরকে আস্বাদ করার মত ততটা নয় বলেই আমার আন্দাজ।
ধরো যদি কোনো রকমের বুনো হাঁস টাস হয়? ডিম পাড়ে যদি? কল্পনা নিজের পরিসীমা বাড়ায়। এখানে তো কিছুই মেলে না। খাদ্য-সমস্যাটা কিছুটা তো মিটতে পারে তাহলে?
বলতে কি এই জন্যেই ওকে আমি এত ভালবাসি। আমার বুদ্ধির অভাবের কিছুটা ওর দ্বারা মোচন হয়। আমার বোকামির ও ক্ষতিপূরক। আমার অনেকখানি প্রতিষেধক, বলতে কি!
আমার যেসব বন্ধু নামজাদা মেয়েদের বিয়ে করেছিল, যারা সান্ত্বনা, মেহ, সুষমা বা লাবণ্যলাভ করেছিল, তৎকালে মনটা একটু, খুঁতখুঁত করলেও এখন আর সে বিষয়ে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। সেই সব স্নেহধন্যরা সুখে থাকুন। তাঁদের নিজেদের সুরম্য উপত্যকায় বিরাজ করুন আনন্দে। সেই সান্ত্বনাদাতাকেও (যিনি মুখেই খালি সান্ত্বনা দিতেন, সত্যিকার সান্ত্বনা যাঁর কাছ থেকে কোনোদিন পাইনি) অকাতরে আমি এখন মার্জনা করতে পারি। এমনকি, আমার যে-বন্ধুটি কেবল বিয়ের দৌলতেই প্রতিভাবান বলে বিখ্যাত হয়েছেন (হতে বাধ্য) তাঁর প্রতিও আমার আর ঈর্ষা নাই। কল্পনাপ্রবণ হয়েই বেশ আমি আরামে আছি।
কল্পনার তারিফ করতে হয়। ডিমের দিকটা আমার একদম খেয়াল হয়নি। ভাবনার দিকটাই ভেবেছি। সম্ভাবনার দিকটা ঠাওর হয়নি। কি হবে, ওর মত অমন মর্মভেদী দৃষ্টিভঙ্গি আমার কই?
থাজ তাহলে। কিছু পাড়ে কিনা, দেখা যাক। আমি বল্লামঃ ওই বোটুকখানাতেই বসবাস করুক। আমাদের বোটুকখানায় এইতো প্রথম এখানকার সামাজিক পায়ের ধূলা পড়লো!
বিকেলে স্টেশনে বেড়াতে গিয়ে বোকেনের সঙ্গে দেখা। (মফঃস্বলে স্টেশনই হচ্ছে একমাত্র গম্যহল—ঠিক রম্যস্থল না হলেও—ওছাড়া আর চড়বার জায়গা কই? সেখানে ঢাকুরিয়ার মত লেক নাস্তি, অন্ততঃ বর্ষাকাল না এলে দেখা যায় না, কাজেই সুন্দর মুখ দেখতে হলে রেলগাড়িরই শুধু ভরসা। তাছাড়া, থিয়েটার যাত্রা সিনেমাও দুর্লভ রেলগাড়ির প্রবেশ ও প্রস্থানেই যা কিছু যাত্রা ইত্যাদি নজরে পড়ে।)
বোকেন আমার দিকে কুটিকুটিল হয়ে তাকিয়ে থাকল খানিক। তারপর মুখভার যারপরনাই কঠোর করে আমার ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ল যেন আমার বন্য কুকুট কোথায়?
বন্য কুকুট? আমি বোকা সাজলামঃ বন্য কুকুট আবার কী হে?
ন্যাকা! ওসব ইয়ার্কি চলবে না। আমার বালিহাঁসটাকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ বলো।
যখন এইভাবে আমার প্রতি লালবাজার-সুলভ-জেরা চলছে ঠিক সেই মুখে যতীন এসে হাজির। তার মুখেও কেমন একটা সন্দিগ্ধ ভাব।
তোমাদের বালিহাঁসের কথায় মনে পড়ল। তোমরা কেউ আমার সখের পারাবতটিকে দেখে? বল্ল সে।
পারাবত? তার মানে? পারাবত তো পায়রা। আমিও না বলে পারি না? মোটেই পায়রার মতো দেখতে নয়।
যতীন আর বোকেন—দুজনেই চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকায়।
নয়ই তো। যতীন একমুখ হাসি এনে ফ্যালে : উড়ে এসে জুড়ে বসলে হয় পায়রা; আর গৃহপালিত হলে হয় কপোত। গৃহকপোত বলা হয়ে থাকে শোনোনি! সেই বস্তুই বাইরে পাওয়া গেলে পারাবত। এই বেড়ালই বনে গেলে বনবিড়াল হয় যেমন হে!
কক্ষনো তা নয়। তোমার বন্যকুকুটও না…আর…আর তোমার বুনো পায়রাও নয়। সারস পাখি আমি কখনো চোখে দেখিনি, যদি হয় তাহলে তাই।
ধরা পড়ে যাবার পর আর পিছিয়ে আসা যায় না। সাফাই দিতেই হয়। তবে যদি বন্য সারস হয় তো বলতে পারি নে। সেই সঙ্গে এটুকুও অনুযোগ করি—বুননদের, সঙ্গে তো এইখানেই আমার আলাপ।।
ওদের গোয়েন্দা-মার্কা চাউনি তখন পরস্পরের ওপরে পড়েছিল। পরস্পরকে সন্দেহ করছিল ওরা। উভয় পক্ষ থেকেই বিপক্ষতার কোনো ত্রুটি হোততা না, মুখোমুখি থেকে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়াত কিন্তু সেই মুহূর্তে একটা ট্রেন এসে পড়ে বাধা দেয়ায় লড়াইটা থেমে গেল।
কুরুক্ষেত্র থেকে আমরা ধর্মক্ষেত্রে চড়াও হলাম। সন্ধি করে ফেলাম। সকলের জবানবন্দী জোড়াতালি দিয়ে জানা গেল, যতীন ঐ পাখিটকে কাল, সন্ধ্যায় তার বাগানে উকি মারতে দেখেছিল। তার ধারণায়, পাখিটাও আমাদের মতই পলাতক, তবে ধারে কাছের নয়, সুদূর থেকে আসা, বৰ্মা মুলুকের আমদানি হওয়াই সম্ভব। আর বোকেন আজ সকালে পা টিপে টিপে তার বাগানের সীমান্তে পৌঁছে পাখিটাকে প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি, সেই সময়ে পাখিটা কেমন করে তার হাত ফসকে (পাখোয়াজির কোথাও গলদ ছিল নিশ্চম) বেড়া টপকে আমাদের এধারে এসে পড়ে।
একজনের প্রথম দর্শন, অন্যজন থি-ফোর্থ ধরে ফেলেছিল, আরেক জনের কাছে ধরা দিয়েছে—অধিকারসূত্রের এরকম ঘোরপ্যাচে—পাখিটা আপাতত আমার আস্তানাতেই বাস করবে স্থির হলো।
বাড়ি ফিরে জানলাম কল্পনা ইতিমধ্যেই ওর নামকরণ কবে ফেলেছে। মীনাক্ষি। নামটা খুব অযথা হয়নি। প্রথম দেখা থেকেই ওর চাউনিতে, বিশেষ করে আমার প্রতি ওর হাবভাবে বিজাতীয় একটা মীনে আমি লক্ষ্য করেছি। মিনেসিং সামথিং, ভাষায় ঠিক তার প্রকাশ হয় না। মীনাক্ষি বললেই ঠিক হয়।
ওকে আমাদের খাবার ঘরে এনে রেখেছি। কল্পনা বল্ল : বোটুকখানায় ভারী একা একা বোধ করছিল বেচারা।
তা; বাগানে কেন ছেড়ে দিলে না? নিজের মনে বেড়িয়ে বেড়াতো।
বাগানে? আমার সাহস হয় না বাপু। কেউ যদি নিয়ে পালায়?
সে কথা ঠিক। এ যা কগান! বাড়ি ভাড়া করেই একটা বাগানবাড়ি পেয়ে গেছি বটে বাগানটা ফাউয়ের মধ্যেই—তবে এ-অঞ্চলে বাড়িমাত্রই বাগানবাডি। চারধাবে ঘেরা বেড়া দেয়া থাকলেও, এসব বাগান তৈরি করা না স্বয়ংসৃষ্ট বলা কঠিন। ঝোপ-ঝাড়-জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে এক একটা মনুষ্যাবাস। তার ভেতরে কোনোটা বাংলোপ্যাটার্ণ কোনোটা একতালা, কোনোটা বা আটচালা, কদাচিৎ একখানা দোতালাও। কিন্তু এগুলো যে কিসের বাগানবাগানের কোষ্টা যে-কী গাছ তার ঠিকুজি ঠিক করা আমার পক্ষে বাতুলতা। পত্র-পাঠ গাছ চেনা আমার অসাধ্য (প্রকৃতিরসিক আমাদের বিভূতি বাড়জ্যে মশাই-ই শুধুতা পারেন)—গাই আমার কাছে ওষুধের মতোই—সেই রকম ত্যাজ্য এবং কেবল ফলেন পরিচয়তে। গাহের কর্মফল না দেখে এবং স্বয়ং ফলভোগ করে কিছুতেই গাছ-চিনতে পারি না। কিন্তু এসব গাছের ফল দেখব তার যো কি?। তলায় পড়া দূরে থাক, গাছেই ভালো করে ধরতে পায় না—পাড়ার ছেলেরা এসে দেখতে না দেখতে ফাঁক করে দেয়। গাছে গাহেই তাদের ফলা, এসব বাগান হচ্ছে মা ফলেষু কদাচন। একমাত্র গীতার কর্মযোগী ছাড়া আর কেউ যে অস্মিন্ দেশে বাগান করার উদ্যোগ করে না তা নিশ্চয়। এখানে হচ্ছে একজনের বাগান এবং আর-সবার বাগাননা। এ বাগানে যদি পাড়ার ছেলেরা এসে এই বেপাড়ার পারাবতকে একলাটি ঘুর ঘুর করতে দেখে তাহলে যে এক মুহূর্ত ছেড়ে কথা কইবে না সে কথা খাঁটি।