অধেক রাত। তার ওপরে অন্ধকারাচ্ছন্ন এই নির্জনতা ফাঁক পেয়ে মানুষের পাজরার ভেতরে ঢুকে হাড় কাঁপিয়ে দিতে চায়।
বাড়ি যেতে চাইবে, সে আর আশ্চর্য কি? আমি ওকে উত্তপ্ত করার প্রয়াস পাই? যারাই কিনা মকদ্বীপে উৎক্ষিপ্ত হয় তারাই বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু কদিন আর? অভ্যেস হয়ে যেতে আর কদিন? প্রথম প্রথম ওইরকম একটু মন কেমন করে। তারপর কিছুদিন গেলে আর কিছুতেই তাদের সেখান থেকে সেই মরুদ্বীপের স্বর্গোদ্যান থেকে সরানো যায় না। রবিন্সন ক্রুসো পড়েছ তো?
কল্পনা বলে, তুমি একটা ক্ষ্যাপা।
কেন, এমন হতে পারে না কি?– আমি ওকে বোঝাতে চাই : অঘটন কি ঘটে না পৃথিবীতে?
বাস্তবিক, যেখানে চিরকাল এত আলোর ঝলমলানি দেখে এসেছি, চাঁদের জ্যোৎস্নাটুকুও যে-পথে কদাচ পড়তে পায়নি, যেখানে পথঘাটের কোনোদিন অন্যরূপ দেখব এমন প্রত্যাশা ছিল না, সেখানে এই বিপুল—অদ্ভুত—অপরূপ অন্ধকার, এই অপরিমেয় রহস্যঘনতা, যা ভাবতেই, আপনিই যত অসম্ভব কল্পনা মনের বলগামুক্ত হয়ে এলোপাথাড়ি ছুটোছুটি লাগিয়ে দ্যায়।
…মিরাকল কি ঘটে না পৃথিবীতে?… আমি বলে চলি: এইমাত্র সিনেমার এক অবাস্তব জগৎ থেকে আমরা উঠে আসছি; আবার সেই আমাদের পুরনো পরিচিত পচা একঘেয়ে জীবনে ফিরে যাবার প্রত্যাশা নিয়ে, কিন্তু এর মধ্যে কী অঘটন ঘটে গেছে, না জানি কী যাদুবলে কলকাতার মায়া কাটিয়ে কোন এক সুদূর আদিম দ্বীপের উপকূলে, আমরা উৎক্ষিপ্ত এখন—যেখানে সভ্যতা নেই, ভদ্রতা নেই, অশান্তি নেই, যুদ্ধবিগ্রহ-মারামারি কাটাকাটি কিছু নেই, নিত্য নবযুগ, নিত্য নব নব হুজুগ নেই—কেবল চারিধারে নীলাম্বুরাশি আর তালীবন, আর শুধু তুমি আছো আর আমি আছি—এমন কি হতে পারে না নাকি?
তুমি একটা ক্ষ্যাপা। কল্পনার কণ্ঠে পুরাতন ঘোষণা।
এটা কি একটা জবাব হলো?
তুমি একটা আস্ত। কথাটা সম্পূর্ণ না করেই, আমার কবল থেকে সবলে তার হাত ছাড়িয়ে নেয় : হ্যাঁ, তাই আমার সন্দেহ হচ্ছে। আমি বাড়ি যেতে চাই। সে বলে।
যাবে বই কি। নিশ্চয়ই যাবে। আমি ওকে ভরসা দিই : যথাসময়েই যেতে পারে। আশ-পাশ দিয়ে একটা জাহাজ গেলে হোলো? আর জাহাজরা তো গিয়েই থাকে, কালেভদ্রে যায় বই কি! তখন আগুন জ্বেলে নিশানা দাও কি তোমার পাঞ্জাবী খুলে নিশান ওড়াও। দ্যাখো, ঐ দ্যাখো, কী একটা যাচ্ছে যেন।–
রক্তচক্ষু অতিকায় জাহাজপ্রতিম কী একটা, ভোঁসর্ভোস গর্জনে, দারুণ আওয়াজ ছেড়ে, বঙ্কিম দৃষ্টিতে আমাদের দিকে বারেক মাত্র কটাক্ষ করেই তীরবেগে অন্ধকারের মধ্যে তিরোহিত হয়ে গেল।
বাস গেল না? কল্পনা আর্তনাদ করে উঠল : বাজে বক করে বাসখানা হারালুম। থামালে কাজ দিত। থামালে না কেন?
কি করে থামাবো? আমি বিস্মিত হই : পাঞ্জাবী খুলে ওড়ানো আমার পক্ষে অসম্ভব। তাছাড়া, সময় পেলাম কই? আর, কলকাতার পথে আগুন জ্বালালে, বুঝতেই পারছো, পেনাল কোডে পাক্কা ছমাস।
পরের বাস আসতে আবার সেই আধ ঘণ্টা। কল্পনা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফ্যালে : আর আসবেই কিনা কে জানে।
নাই বা এলো। আমি ওকে সান্ত্বনা দিইঃ মরুদ্বীপে সময় হু হু করে কেটে যায়। টেরই পাওয়া যায় না। আর এমন আরামে কাটে। এমন কি, সেখানে বসে এক-আধটু রোমান্সও করা যায় না যে তা নয়।
ছবিতে দেখেছি বটে। কল্পনার শুষ্ক কণ্ঠ।
দেখলেই বা, রোমান্সে কোনো দোষ নেই আমি ওকে বুঝিয়ে দিই : আব তাছাড়া রোমান্স করতে হলে মরুদ্বীপে নিক্ষিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে তারও কোনো মানে নেই। রমণীয় যা, জো পেলেই জোগাড় করো-বাগে পেলেই বাগিয়ে নাও। রোমান্সের চুলের টিকি পাকড়ে আনো। অনেক বছব আগে, এমন একটা চমৎকার আঁধার রাত পেলে তুমি কী উচ্ছ্বসিতই না হতে।–
অনেক বছর আগে, তার মানে? কল্পনা প্রতিবাদ করে।
না, তত বেশি বছর আগে নয়। আমি ক্ষতিপূরণ করে দিই : কেন, তোমার গলার সুরে তো বোধ হচ্ছে যেন এই সেদিনের কথা। মনে হচ্ছে, সেই তুমি, সেই তরুণবয়সী তুমি, অনেক বছর—মানে, অল্প কিছুদিন আগের সেই তুমিই।
আমার গলার রেশ আমার কানে এসে লাগে। বেশ লাগে। নিজের স্ত্রীকে কেমন যেন পরস্ত্রী বলে মনে হয়।
এখনো তুমি ঢের কাঁচা, ঢের কচি। এখনো তোমাকে নিয়ে রোমান্স করা চলে।… আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলি! আমার আত্মপরভেদ লোপ পায়,—নিজের স্ত্রীর প্রতিই কেমন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করি—কেমন যেন পরস্ত্রীকাতারের মতো হয়ে পড়তে থাকি ক্রমশঃ।
…এমন চমৎকার রাত…এহেন মোহিনী অন্ধকার…তুমি আর আমি এত পাশাপাশি…
নিজের গলা শুনে নিজেই বিগলিত হই। আমার মধ্যে এত মাধুর্য আছে–তাহলে না তো! এমন মধুর কন্ঠ যে আমিও কখনো শুনিনি।
…এসো, আরো কাছে এসো। আমায় একটা চুমু দাও। এই বলে কস্তুরীকা আপনগন্ধে আপনি মাতোয়ারা হয়ে ওকে কাছে টেনে একটা চুমু খেয়ে নিই।
এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রেয়সী, আমার গালে এক চড় বসিয়ে দ্যান। বেশ মজবুত হাতের যুতসই এক চড়।
কী সাহস তোমার। কল্পনা হাঁপায় : এতদূর আস্পর্ধা।
বা রে, নিজের বৌকে যদি চুমু খেতে না পারো, আহত গালে হাত বুলোতে বুলোতে বলি : তাহলে কার বৌকে চুমু খেতে যাবো, শুনি?
যা? তার ওপরে আবার একটা বউ আছে বাডিতে? বটে? কল্পনা ফোঁপাতে থাকে : আগেই বোঝা উচিত ছিল আমার।
এই বলে কল্পনা, আর একটি কথাও না বলে অদ্ভুত আবহাওয়ায়, মরুদ্বীপ ত্যাগ করে জলে নেমে পড়ল এবং টলতে টলতে জলাশয় পাব হয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেল।