মাখম-মাখানো আলু-সফুল গন্ধ-ভুরভুরে গরম গরম সেই খিচুড়ি, অমলেটের সাহায্যে কী তোফাই যে লাগলোতা আর বলবার নয়। তার সাথে মাঝে মাঝে চাটনি——পাঁপড়ের টুকরো—আচারের টাকরা—প্রভৃতিরা—আর অবশেষে, সবশেষে চা, আহা,–বলাই বাহুল্য।
সেদিন রাত্রে বাড়ি ফেরার পর কল্পনা বলল : বলতে গেলে হয়তো তুমি ছোটলোক বলবে! কিন্তু আমাদের চায়ের বাকীটা, সেই প্যাকেটটা, সঙ্গে নিয়ে আসা উচিত ছিল। প্রায় আধ-পোটাক চা–পাঁচ আনা দাম তো।
সংসারে ফিরে এলে উচ্চ নজরও তুচ্ছ খবরে নেমে আসে। সংসার এমনিই! তাছাড়া, তিল কুড়িয়েই তাল, তে কি। এবং যে সব তিলোত্তমাকে সেই তাল সামলাতে হয় তাঁরাই জানেন।।
পকেট থেকে বার করে বিনাবাক্যব্যয়ে চায়ের প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিই।
কিন্তু এতো —আমাদের কেনা চায়ের প্যাকেট নয়। …একি? …য়্যাঁ? ১/৩ বিস্মিত, ১/৩ বিমুগ্ধ, ১/৩ বিরূপ দৃষ্টিতে আমার দিকে সে তাকায়।
এ ছাড়া—ভেবে দ্যাখো—ওদের পিকনিকে যেগ দেবার আর কোনো উপায় ছিল। আর তুমি—তুমিও চা চা করে যেমন চাতকের মত হয়ে উঠলে–কী করব?
কৈফিয়তের সুরে আমি বলি : আর তোমার জন্যে—বলো–কী না আমি করতে পারি?
সহধর্মিণীর জন্যে লোকে সহনীয় অধর্ম তো করেই, করে থাকেই, অসহনীয় ধর্মাচরণেও পেছপা হয় না—আমি আর এমন কী বেশি করেছি? দস্যু রত্নাকরের খুনসুরি থেকে শুরু করে তাজমহল স্রষ্টার প্রিয়তমার কর-ই রচনা—অহো। আগাগোড়া সব জড়িয়ে শেষ পর্যন্ত আমার নিজের জ্বাজ্বল্যমান উদাহরণে এসে পৌঁছব—জবাবদিহির এই সব পাচ মনে মনে ভাঁজছি, কল্পনা আমার চিন্তাশীলতায় বাধা দেয় : অবশ্যি, চায়ের জন্যে কী না করা যায়! তা ঠিক। কিন্তু তা বলে এতটা—এতদূর–কূটনৈতিক ভাষায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে অবশেষে ও স্পষ্টবাদী হয়ে পড়ে : য়্যাঁ? শেষটায় চুরি-চামারিও তুমি বাদ দিলে না। ছি ছি!
দ্যাখো, আর যাই বলো চুরি বলো না! ক্ষোভার্ত কণ্ঠে আমি বলি : চামারি বলতে পারো ইচ্ছা করলে।… কিন্তু যারা দুবেলা চা মারে তাদের আর চামার হতে বাকী কী?
হাতসাফাইটা করলে কখন শুনি? অবাক লাগছে আমার!
সেই যখন ঝুঁকে পড়ে খবরের কাগজের ওপরে সমবেত খাদ্য-তালিকাদের দেখছিলাম, সেই সময় ওদের এই চায়ের প্যাকেটটাকে অসহায় অবস্থায় পেয়ে—প্রথম দর্শনেই–
যাও যাও, আর বলতে হবে না। ছি ছি! কল্পনা কানে আঙুল দ্যায়।
৭. বিটকেল আওয়াজে ঘুম ভাঙল
বিটকেল আওয়াজে সেদিন সকালের ঘুম ভাঙল। আওয়াজটা পিছনের বাগান থেকে লাফিয়ে উঠে শোবার ঘরের জানালা ভেদ করে বর্শার মত আমার কর্ণমূলে এসে বিঁধল। কল্পনার তারস্বর তাতে ভুল নেই, কিন্তু কতটা বীরত্বঘটিত হলে তা তীরস্বরে পরিণত হতে তার কল্পনাতেও কোনদিন ছিল না। সেই মুহূর্তে স্বকর্ণে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করা গেল।
এবং শুধু কাল্পনিক কণ্ঠই নয়, সেই সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে আরেক কেকা-ধ্বনি! আনকোরা অচেনা গলার কক কক। সঙ্গে সঙ্গে নীচের ঘরে সশব্দে দরজা বন্ধ হওয়ার খবর পাওয়া গেল। তারপর সব চুপ।
তীরস্বর শুনেই, কল্পনা ধনুর্ধারের মত কিছু একটা করছে টের পেয়েছিলাম। জানালা খুলে মাথা বাড়িয়ে খোঁজ নিলাম।
কার সঙ্গে আলাপ করছিলে গা?
একটা পাখি ধরেছি। কল্পনা ব্যক্ত করল।
পাখি? কী পাখি?
দেখে যাও এসে। পুরে রেখেছি আমাদের বোটুকখানায়। নামলাম নীচে। কল্পনা খুব সাবধানে বৈঠকখানার দরজা দেড় ইঞ্জিটাক ফাঁক করল। সাহস বুকে বাঁধতে হলো আমায়। কে জানে,একটা ঈগল কি উটপাখিই হবে হয়ত; তাড়া করে আসে যদি? যতদূর সম্ভব সতর্কতা অবলম্বন করে সেই দেড় ইঞ্চি যকের ভেতর দিয়ে আধ ইঞ্চি দৃষ্টি চালিয়ে দিলাম। বহু চেষ্টার পর, টেবিলের আড়ালে, আমার গদি আঁটা স্মোরে উপবিষ্ট পাখির মত চেহারার একজন আমার চগোচর হলো।
পাখির মত হাবভাব, কিন্তু পাখি কিনা নিশ্চয় করে বলা শক্ত। পাখির মত চেহারা, পাটকেলের মত রঙ (হঁটের মতও বলা যায়), হাতলের তলা দিয়ে প্যাট প্যাটু করে আমার দিকে চাইছে। ভারী বিরক্ত চাউনি। আর জলের কলের দম বন্ধ হলে যে রকম বকুনি বেরয় অনেকটা সেই জাতীয় ব-ব-নিনাদ!
কী পাখি? জিজ্ঞেস করল কল্পনা।
সূক্ষ্মদৃষ্টির সাহায্যে যতটা পারা যায়, পক্ষী-আকারকে আমি মনে মনে পরীক্ষা করলাম। পাখি বলেই তো বোধ হচ্ছে। আমি বল্লাম। উড়ে এসেছিল, না কি?
প্রায় উড়েই এল বইকি। জবাব দিল কল্পনা : কিংবা কেউ ছুঁড়ে দিল যেন। বোকেন বাবুদের বাগানের দিকটা থেকে এল?
দ্যাখো, এখানে আমরা ফেরারী হয়ে এসেছি। আমার প্রখরদৃষ্টির খানিকটা পাখির থেকে টেনে কল্পনার মুখে নিক্ষেপ করি। এখনো এখানকার সকলের সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়নি। এস্থলের ইতরভদ্র প্রাণীদের কে কী ধরনের কিছুই জানিনে। এমতাবস্থায় সম্পূর্ণ অপরিচিত কাউকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয়া কি ঠিক হবে? চোখ কান ঠুকরে নেয় যদি?
বাস্তবিক, ইভ্যাকুয়েশনে আসা আর খুন করে পালানো আসামীতে কোনো প্রভেদ নেই। কারো তারা প্রতিভাজন না। সবাই তাদের বিষ নজরে দ্যাখে। স্থানীয় বাজার-দর বাড়ানোর কারণ বলে বাজারের কারো কাছে তাদের আদর নেই। এমনকি, ওই পাখিটা পর্যন্ত দ্যাখো না, দুই চোখে বিদ্বেষ উদগীরণ করছে! ভেবে দেখলে, বোমার ভয়ে কলকাতা থেকে পালিয়ে শেষে এই বিভঁয়ে এসে বুননা পশুপক্ষীর গর্ভে যাওয়া কোনো কাজের কথা বলে আমার বোধ হয় না। অপরের জিতে নিজের স্বাদ গ্রহণ খুব উপাদেয় নয়,