ও, আপনিই! যাক, বাঁচিয়েছেন। আমি উৎসাহিত হয়ে উঠি: গাঁয়ের ওরা বললে আপনি নাকি—মানে আপনার নাকি—মানে—আপনার এখানে কিনা—
কী করে কোন ভাষায় যে চায়ের নেমন্তন্নটা অযাচিতভাবে গ্রহণ করবার সুযোগ নেব ভেবে পাইনে।
আপনি নাকি মনে করলে আমাদের একটু চা খাওয়াতে পারেন। কল্পনার কিন্তু বলতে দেরি হয় না। প্রাণকাড়া একখানা হাসি হেসে চোখ ঘুরিয়ে কথাটা বলে দ্যায়।
বাস্তবিক, অদ্ভুত এই মেয়েরা! ভাবলে চমক লাগে! সত্যি, পৃথিবীতে এরা না থাকলে অব্যর্থ আমরা গোয় যেতাম।
কেদার কাকু নিজের দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে প্রকাশ করলেনঃ ও—হ্যাঁ–তা ওরা ঠিকই বলেছে। কিন্তু চা আমার পুরোণো খুব। তিন মাসের মধ্যে নতুন চা আসেনি—জেলায় আর যাওয়া হয়নি কিনা। কিন্তু চা তৈরির তো কোনো পাট আমার নেই। এমনি ছটাক খানেক দিতে পারি—অরই রয়েছে। পাঁচ আনা লাগবে কিন্তু।
আপনি–আপনার এখানে চা তৈরি হয় না? কল্পনার তারস্বর—হতাশার সুরে মেশানো।
আমার এটা মুদির দোকান—চায়ের আড্ডাখানা না! কেদার কাকুর বিরক্তিম মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। পাঁচ আনা দিয়ে আধ ছটাক চা-র একটা প্যাকেট বগলদাবাই করে আমরা সেই গ্রামের দ্বারদেশ থেকে ছিটকে বেরুই। এবং আবার আমাদের অভিযানে বেরিয়ে পড়ি।
তারপর কত যে হাঁটি তার ইয়ত্তা হয় না—স্টেশনের দিকেই হাঁটবার চেষ্টা করি। কিন্তু বিভিন্ন পথিকের বিবৃতি থেকে যা টের পাই তার থেকে এহেন ইষ্টিসন-বহুল গ্রাম যে ভূপৃষ্ঠে আর দুটি নেই এই ধারণাই আমাদের হতে থাকে। এখান থেকে–পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ-যেদিকেই যাই না কেন একটা করে স্টেশন পাবো—অচিরেই পেয়ে যাবে—দশ বিশ মাইলের মধ্যেই পাওয়া যাবে তাও জানা গেল। এমনকি, সরাসরি নাকের বরাবর নৈশৃং কোণ ধরে চলে গেলেও আর একটা নাকি পেতে পারি, সেরকম সম্ভাবনাও রয়েছে। অতএব কোনদিকে যাওয়া শ্রেয় হবে স্থির করতে না পেরে, অস্থির হয়ে আমরা দিঘিদিকে চলতে শুরু করে দিলাম।
চলতে চলতে হঠাৎ এক অভাবনীয় দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে উদঘাটিত হলো। পার্শ্ববর্তী ছোট্ট একটি আমবাগানের ছায়ায় দুটি হেলে-স্কুল-পালানো বলেই সন্দেহ হয়—পিকনিকের আযোজনে মশগুল বয়েছে।
সুচারু একটি পিকনিক! স্টোভে খিচুড়ি চাপানো হয়েছিল প্রায় শেষ হয়ে এল বলে—ভুরভুরে তার স্টে চারিদিক আমোদিত। পেঁয়াজ ছাড়ানো। ছোট বড় গোটাকতক ডিম কাছাকাছি। ডাগডি যাচ্ছে—খিচুডির সাথে আমলেটেব যোগাযোগ হবে আন্দাজ করা কঠিন নয়।
ঘেসো জমির ওপর খবরের কজ বিছানো হয়েছে। তার ওপরে ঝকঝকে চিনেমাটির প্লেট—খিচুড়ির আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় সেজেগুজে বসে।
আহা! আমার জিভে জল এসে যায়। চাযের তেষ্টা তো ছিলই, তার ওপরে খিদেও পেয়েছিল বেশ।
এক প্লেট খিচুরি পেলে মন্দ হতো না। এই কথাটা স্বগতোক্তির নেপথ্যেই রেখে দি।
চায়ের কাপও রয়েছে দেখেছে!কল্পনা দেখিয়ে দ্যায়। তাবা মনে, চায়ের আয়োজনও হয়েছে ওদের বলতে গিয়েও মুখ ফুটে বলতে পারে না ও—মনের মধ্যেই চেপে রাখে। ওর জিভের খবর বলতে পারি না, তবে ওই কথাটাই ওব নখ চোখে উম্মুখর হয়ে—ভরপুর হয়ে উঠেছে, দেখতে পাই।
খবরের কাগজের ওপরে আরো কী কী যেন ছিল—আচার, আমসত্ত্ব, পাঁপড়, হানার মণ্ডা, মাখন এবং আরো কী কী সব-পাশ দিয়ে যাবার সময়ে, ঝুকে পড়ে, খুঁটিয়ে দেখবার আমি চেষ্টা করি—দেখেই যতটা সুখ। কল্পনা আমাকে এক হ্যাচকা লাগায়। চলে এসো! ছিঃ! ওকি? হ্যাংলা ভাববে যে!
অবশ্যি, দেখতে পায়নি। হেলে দুটি খিচুড়ি নিয়েই মত্ত। তাহলেও কল্পনাই ঠিক। পরের খিচুড়ি এবং ইত্যাদি—পরকীয় যা কিছু, চেখে দেখার আশা নেই তা শুধু শুধু চোখে দেখে লাভ? সুধা দেখলে কি আর ক্ষুধা মেটে?
পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ করে ফের আমরা রওনা দিই। কল্পনা আমাকে বকতে বকতে যায় তোমার ভারী পরের জিনিসে লোভ! বিচ্ছিরি! কেন, আমি—আমি তো একটুও লালায়িত হইনি।… সুরুৎ করে জিভের ঝোল টেনে নিয়ে সে জানিয়ে দেয়।
আমবাগানটা পেরুতে না পেরুতেই বিরাট এক চিৎকার এসে পৌঁছয়। আওয়াজটা আমাদের তাড়া করে আসে। আমরা দাঁড়াই, সেই হেলেদুটিই দৌড়তে দৌড়তে আসছে।
আপনাদের পিছু ডেকে বাধা দিলুম, কিছু মনে করবেন না। ওদের একজন কিন্তু-কিন্তু হয়ে বলে: দেখুন, আমরা ভারী মুস্কিলে পড়েছি—পিকনিকে সমস্ত আনা হয়েছে, কেবল চায়ের প্যাকেটটা আনতে ভুলে গেছি। অথচ, সব কিছু হলেও, চা ছাড়া কি পিকনিক জমে, বলুন তো?
অপর ছেলেটি শুরু করে পাশের জেলা থেকে বেড়াতে এসেছি—এখানকার দোকান হাট কোথায় কিছু জানিনে। কোথায় গেলে চা কিনতে পাওয়া যাবে, মুদিখানা কিম্বা মনোহরী দোকানটা কোন ধারে বলে দেবেন দয়া করে?
মুদিখান। এখান থেকে ঢের দূর। প্রায় একখানা গ্রাম জুড়েই একটা মুদিখানা। আমি বলিঃ কিন্তু তার দরকার কী, আমাদের সঙ্গেই এক প্যাকেট চা আছে—ইচ্ছে করলে নিতে পারো—স্বচ্ছন্দেই।
দেখেছিস! একটি ছেলে জ্বলজ্বলে চোখে আরেকটির দিকে তাকায়। একেই বলে বরাত—দেখলি তো। কী বলেছিলাম? ধন্যবাদ। আপনাদের কী বলে যে ধন্যবাদ দেব বলতে পারি না। তা—তা এর দাম কতো?
ও-না না। সে তোমাদের দিতে হবেনা।আমি হাত নেড়েকথাটা উড়িয়ে দিই—প্রায় মাছি তাড়ানোর মতই।
এবং এর পর—এর পর আর ওদের কী করবার ছিল? নিতান্তই যা ছিল তা না করে উপায় ছিল না। এবং পর পর অনিবার্যরূপেই মিনিট দশেক বাদে সবাই আমরা, সেই ভূপতিত খবরের কাগজকে ঘিরে খিচুড়ির চার পাশে জমায়েত হলাম।