হয়েছে হয়েছে, খুব হয়েছে। যেমন পুরাণ, তেমনি ইতিহাস, সবই তোমার নখদর্পণে—টের পেয়েছি বেশ। এখন কোথায় গেলে একটু চা পাওয়া যায় তা যে কেন তোমার মাথায় আসছে না, তাতেই আমি ভারী অবাক হচ্ছি।
দাঁড়াও না। এক্ষুনি একজন সদাশয় অতিথি-বৎসল আদর্শ গ্রাম্য লোকের দেখা পেলুম বলে। আমাদের দেখেই তিনিই আপ্যায়িত হয়ে অভ্যর্থনা করবেন—চা-তো খাওয়াবেনই, সেই সঙ্গে চিড়েমুড়কি-ঘোরো গোরুর খোড়ো দুধ—সমস্ত মিলিয়ে মিষ্টি একটা ফলারও বাদ যাবে না। শুনেছি পাড়াগাঁর ওরা নিরাশ্রয় বিদেশী লোক দেখলেই কোন কথা শোনে না, ধরে বেঁধে খাইয়ে দ্যায়।
সেসব দিন গেছে। কল্পনার হাহুতাশ শুনিঃ এসব দৈত্য নহে তেমন। দুঃখের চোটে, হেমচন্দ্র থেকে পঞ্চোদ্ধার করতেও সে বাকী রাখে না।
আচ্ছা, এইবার কাউকে দেখতে পেলে জিগেস করব। আমি বলি। মরিয়া হয়ে বলি।
দেখতে পেলে তো। কল্পনা বিশেষ সান্ত্বনা পায় না।
বাস্তবিক, এতক্ষণ ধরে, এতখানি পথ—এত গণ্ডা চষা এবং না-মা মাঠ পার হয়ে এলাম, দু-একটা গণ্ডগ্রামও যে না পেরিয়েছিল তা নয়, কিন্তু বাক্যালাপ করবার মতো একটা মানুষ চোখে পড়ল না। যাও বা এক আধটা আমাদের সীমান্ত প্রদেশ ঘেঁষে গেছে, তাদের চাষাভুষো ছাড়া কিছু বলা যায় না। চাষা কি আর চায়ের মর্ম জানে, চায়ের সোয়াদ চায়? তাকে চায়ের কথা জিজ্ঞেস করাও যা, আর কল্পনাকে চাষের কথা জিজ্ঞেস করাও তাই—একজাতীয় কল্পনাতীত ব্যাপার!
কিন্তু না, এর পর যে ব্যক্তিই সামনে পড়বে, তা সে যেই হোক, তার কাছেই চায়ের কথা পাড়ব। এ-গাঁয়ের চাষাই হোক আর ভুষোই হোক, প্রথম কথাই চায়ের কথা এবং চায়ের ছাড়া অন্য কথা না।
এবং পড়লও একজন সামনে!
তিনটে চষা ক্ষেত আর সিকি মাইল সরু আলের রাস্তা ডিঙিয়ে গিয়ে তার দেখা মিলল। গাছের মগডালে পা ঝুলিয়ে বসেছিল লোকটা। গাছের ডালে বসে থাকাটাই বোধ হয় এধারকার লতি ফ্যাসানট্যাকসোবিহীন আমোদ-প্রমোদ—এইরকম আমার ধারণা হয়েছে। যখনই কোনো গেঁয়ো লোকের প্রাণে ফুর্তির সঞ্চার হয়, সাধ হয় যে একটু হাওয়া খাই, অমনি সে খুঁজে পেতে বিলাসিতার নামান্তর সহনশীল একটা গাছ আবিষ্কার করে তার ডালে উঠে বসে থাকে।
এখানে চাখানা কোথায় বলতে পারো? বৃক্ষাশ্রী লোকটাকে আমি প্রশ্ন করি।
ও নামে কেউ এখানে থাকে না। পা দোলাতে দোলাতে সে জানায়। এবং তার কাছ থেকে কিছুতেই এর বেশি আর কিছু বার করা যাবে না। আমরা তাকে গাছের ডালে পরিত্যাগ করে আবার আমাদের ভূপর্যটনে বেরিয়ে পড়ি।
এর পরেই একটি তরুণী মহিলার সহিত আমাদের ধাক্কা লাগলো। মেয়েটি রাস্তার ওপরে বসে ধূলো-মাটি জমিয়ে বালির ঘর রচনায় ব্যস্ত ছিল—কি এমনও হতে পারে, মাটির বানানো পুলিপিঠেই বানাচ্ছিল হয়ত বা।
খুকি, শোনো তো? এখানে কোথায় চা পাওয়া যায়, জানো তুমি? কল্পনাই জেরা করে।
হ্যাঁ, জানি। খুকি তার সপ্রতিভ ছোট্ট ঘাড়টি নেড়ে তক্ষুনি জানায় আমাদের কেদার কাকু। কেদার কাকু চা ব্যাচে। কেদার কাকুর কাছে চলে যাও।
কোথায় থাকেন তিনি—সেই তোমাদের কেদার কাকু? এই গাঁয়ের শেষে—একেবারে শেষে গিয়ে।
খুকির ব্যবহারে এবং বুদ্ধিমত্তায় চমৎকৃত হই। তৎক্ষণাৎ পকেট হাতড়ে কে দুটো আনি ওর দু হাতে সঁপে দিই—সত্যি, পৃথিবীতে মেয়েরা না থাকলে—এই স উপাদেয় প্রাণীরা আজো না টিকে থাকলে আমরা দাঁড়াতাম কোথায়?
তারপর—চলেছি তো চলেইছি। যে-গাঁয়ের অবশেষে কেদার কাকুর উপনিবেশ সে গাঁ আর আসে না। এক মাইল হাঁটাহাঁটির পর আমি বলি : এতখানি পথ পেরিয়ে এলাম, এতক্ষণে তো সে গ্রামে আমাদের পৌঁছানো উচিত ছিল।
আমিও সেই কথাই ভাবছি। কল্পনাও ভাবিত হয়েছে দেখা যায় : আরো কতোদূরে গ্রামটা, এসো, ঐ বুড়ো লোকটাকে জিজ্ঞেস করে জানা যাক।
আমাদের প্রশ্ন শুনে বুড়ো লোকটি আকাশ থেকে পড়লেনঃ সে-গ্রাম তো তোমরা পেছনে ফেলে এসেছ বাপু! আনমনা হয়ে ছাড়িয়ে এসেছ, তাই তোমাদের নজরে পড়েনি।
বুড়ো লোকটি ভারী অবাক হয়ে যান—এবং আমরা—ততোধিক অবাক হই।
যাই হোক, ফিরে চলি আবার—এবারে দুধারে খর-দৃষ্টি চালিয়ে যাই—দুজনেই কড়া নজর রাখি—যাতে ফের আবার কোনো গতিকে না ফসকে যায় গ্রামখানা।
আমার-আমার মনে হচ্ছে এইটাই বোধ হয় সেই গাঁ। পথিমধ্যে থেমে পড়ে কমনা আপন সংশয় ব্যক্ত করে।
এটা যদি এদের গ্রাম হয়— আমি বলি–তাহলে পর্ণ কুটির বলতে এরা কী বোঝে তাই আমি জানতে চাই।
আমরা কুটির ওরফে সেই পল্লীগ্রামের দ্বারে গিয়ে ঘা মারি। দরজা বলতে বিশেষ কিছু ছিল না-দরজার পাঠান্তর সেই নামমাত্র একটি যা ছিল তার ওপরে করাঘাত করতে হলে যথেষ্ট সাহসের দরকার—কেননা তার ফলে গ্রাম-চাপা পড়বার দস্তুরমতই আশঙ্কা ছিল।
কল্পনার হারমোনিয়াম বাজিয়ে অভ্যেস–সে-ই করাঘাতের দায়িত্ব নেয়। আমি গ্রামের আওতা থেকে সরে দাঁড়াই। কাপুরুষতার জন্যে না, দৈবাৎ যদি একজন গ্রামের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে নিমজ্জিত হয়—তাহলে তাকে সেই গ্রাম্য সমাধির কবল থেকে উদ্ধার করতে, নিতান্ত না পেরে উঠলে সেই গ্রামেই সমাধি দিয়ে ফিরতে আরেক জনের থাকা দরকার।
করাঘাতে একটু পরেই, গ্রাম ভেদ করে—কিংবা গ্রামান্তর থেকে একটি বুড়ো লোক বেরিয়ে আসেন।
কেদারবাবু এখানে থাকেন কোথায় বলতে পারেন দয়া করে? দুজনেই যুগপৎ জিগেস করি : কেদারবাবু ওরফে কেদারকাকু?
আমিই কেদারকাকু।