যাও। এদিকে চায়ের তেষ্টায় প্রাণ যাচ্চে–তোমার ইয়ার্কি আমার ভালো লাগে না।
বাস্। আমি তো নেমেই চায়ের কথা তুলেছি। রেলওয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই যাচ্ছিলাম—তুমিই বাধা দিলে।
আমাদের আগে আগে রেস্তোরাঁয় সেই মেয়েগুলো ঢুকলো না? মনে নেই তোমার?
হ্যাঁ, সেই অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান মেয়েরা? তাতে কী?
কী সব খাটো খাটো ফ্রক-পরা তাদের–দেখেছিলে তো?
দেখেছিলাম।
তুমি যে দেখেছিলে সেটা আমিও দেখেছি। লক্ষ্য করতে আমার দেরি হয়নি।–আর সেই কারণেই ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না আমরা স্থির করলাম।
আহা? আহা। কল্পনার এই স্ব-গৌরবে বহুবচন—আমার ন্যায় নেহাৎ আ-স্বামীর পক্ষে এর জবাব আর কী আছে? তবুও আমতা আমতা করে বলতে যাই। কিন্তু ওরা তো বাঙালী নয়? মেম তো?
কিন্তু তা হলেও—তবুও তো অসময়ে চায়ের পিপাসা জেগে উঠতে তোমার কোন বাধা হয়নি।
তোমার ভারী সন্দিগ্ধ মন। আমার বিশ্বাস, দার্জিলিঙে গেলে তুমি আমাকে কাঞ্চনজংঘার দিকেও চোখ মেলে চাইতে দেবে না। আমাকে দেখছি সব সময়েই এভারেস্টের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হবে।
বলার সাথে সাথে, দৃষ্টান্ত-স্বরূপ, (দার্জিলিঙে না গিয়েই) এভারেস্টের প্রতি ভ্রূক্ষেপ করি। আমার চিরতমার আগাপাশতলা বারেক পর্যবেক্ষণ কবে নিই—এমনকি, অভ্রভেদী গিরিশৃঙ্গ (সম্প্রতি কুটিকামুক্ত) অব্দি বাদ যায় না। আগার দিক থেকেই আগাই-গোড়ায়।
ইয়ার্কি কোরো না, যাও! কল্পনা রাগ করে।
ইয়ার্কি হলো কোনখানে? ভেবে দেখলে তুমিই তো আমার, একাধারে, ইভ এবং রেস্ট,—আর দ্বিধামুক্ত হলেই-এক কথায় ঐ! ব্যাকরণমতে দাঁড়ায় এভারের সুপারলেটিভ! তাই নও কি? সাদা বাংলায় যাকে চিরন্তনী বলে গো!
কল্পনা কোনো জবাব দেয় না। কথাটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে হয়ত বা।
অবশ্যি কবিতা করেও বলা যায় কথাটা। সাদা বাংলাতেই আজকাল কবিতা লেখা হচ্ছে কিনা! আমি দৃষ্টান্তের দ্বারা আরো প্রাঞ্জল করি : সুধীন দত্তের লেখা পড়েছো তো? পড়োনি?
খুব হয়েছে। আর ব্যাখ্যানায় কাজ নেই। এখন কোথায় চাখানা আছে একটু দয়া করে দেখবেন মশাই?
এভারেস্টের উচ্চতম চূড়া থেকে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলে বাক্যস্ফূর্তি কেন, সব ফুর্তিই লোপ পায়। আমিও আর উচ্চবাচ্য না করে চুপটি করে চলতে থাকি। ইতস্তুত-বিক্ষিপ্ত গোবরদের সন্তর্পণে বাঁচিয়ে, ছোটখাট খানাখন্দ, উঁচু-নীচু নীরবে অতিক্রম করে চলি।
একটু পরে কল্পনাই নিজের থেকে পাড়ে : তখন আমি এইজন্যেই বলেছিলাম যে টিফিন ক্যারিয়ার সাথে নিই। তুমিই তো না করলে। আনতে দিলে না আমায়।
আমিও না বলে পারি না: যত দোষ নন্দ ঘোষ!
এক বাক্যে, ঐ একটি মাত্র প্রবচনে, আমাদের অসন্তোষ ব্যক্ত করি—আমার আর নন্দ ঘোষের।
এবার ও গম্ভীর হয়ে যায়। বহুক্ষণ গুম-কোন কথাবার্তা নেই। আমাকে ব্যস্ত হতে হয় অগত্যা। আমার কি রকম যে স্বভাব-অপর কেউ গুম্ হলেই আমি যেন খুন হয়ে যাই। কোথায় আমার খুনসুটি লাগে, বুকের মধ্যে গুমরে ওঠে। ডিজিটালিস খেয়ে, এমন কি, গীতার সেই মারাত্মক শ্লোক আউড়েও কোনো ফল হয় না কিছুতেই এই ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্বলং কাটিয়ে উঠতে পারি না দেখা গেছে। মার্জনা-প্রার্থনার সুরে, মার্জিত স্বরে অনুতাপের আর্জি পেশ করি।
খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে বিশ্বাস করাই ভুল হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম যে কী বড়লোকের অট্টালিকায় আর কী ছোটলোকের হট্টমন্দিরে রাজপ্রাসাদেই কী আর পর্ণ কুটিরেই বা কী, বাংলার ঘরে ঘরে ভারতীয় চা আজকাল সমাদৃত হচ্ছে। এখন দেখা যাচ্ছে তা নয়—অন্তত ঠিক ততটা নয়।
টিফিন ক্যারিয়ারটা আনতে দিতে কী হয়েছিল? কল্পনার সেই এক কথা—প্রাচীন পরিকল্পনা।
থার্মোফ্লাসকে চাও আনা যেত। এখন তাহলে যেখানে হয় বসে পড়ে মজা করে পিকনি করা যেত কেমন?
আনতে দিতে আর আপত্তি কী ছিল, কেবল বইতে তোমার কষ্ট হতো বই তো না–তাইতো বারণ করলুম। মানে—মানে আমারই হাত ব্যথা হয়ে যেত কি না শেষটায়,-কল্পনার বহন-নৈপুণ্যে আমি অতাব নাস্তিক্যবাদী।
টিফিন-ক্যারিয়ারের প্রস্তাবটা একধারে যেমন মুখরোচক, দূরদৃষ্টি আর বিচক্ষণতা-সহকারে চিন্তা করে দেখলে, অপরদিকে তেমনই ঘর্মাক্তকর-দিব্যদৃষ্টির সাহায্যে এই মর্মান্তিক ভবিষ্যৎ, পা বাড়াবার আগেই আমি পরিষ্কার দেখেছিলাম, কল্পনার কাছে এই অপরাধ এখন মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করি।
তুমি ভারী স্বার্থপর! ও বলে: নিজের হাত পার ওপর এত দরদ তোমার?
তা স্বার্থপর আমি একটু বইকি। ভূতপূর্ব আমার সেই ভবিষ্যৎ-দর্শন এবার আরো একটু স্পষ্ট করি : ভেরে দেখলাম এও তো হতে পারে, তুমি নিজেই অচল হয়ে পড়লে! হাঁটাহাঁটির বালাই তো নেই আমাদের। তখন এক হাতে টিফিন ক্যারিয়ার আরেক হাতে তুমি কোনটা সামলাই? আর, গ্রাম্য দৃষ্টিতেও সেটা খুব সুদৃশ্য নয়! এমনিতে হয়ত একটা বোঝা তত বেশি না—কিন্তু তার ওপরে শাকের আঁটি চাপালেই মাটি! ঐতিহাসিক উটের পিঠে চূড়ান্ত তৃণখণ্ডের মতোই দুঃসহ কাণ্ড! তা ছাড়া ছাড়া বিষয়টা আমি আরো খোলসা করি: দুটো বোঝা থাকলে হয়ত আমি দোনামোনায় পড়ে যেতাম। ওরকম অবস্থায় মানুষ অপেক্ষাকৃত হাই বেছে নেয় কিনা!
জানি জানি, আর বলতে হবে না। কল্পনা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠে: তুমি টিফিন ক্যারিয়ারটাই হাতে নিয়ে ট্যাং ট্যাং করে বাড়ি ফিরে যেতে আমি খুব জনি।
মোটেই না। আমি গম্ভীর ভাবে ঘাড় নাড়ি: আমি তোমাকেই নিতাম। টিফিন ক্যারিয়ারের চেয়ে মাউন্ট এভারেস্টই আমার কাছে বেশি হাল্কা মনে হতো। তাছাড়া, পর্বতচূড়া বইবার ভাগ্য কজনের হয়? হলে কজন সে সুযোগ ছাড়তে পারে? পুরাকালে সেই একদা শ্রীমান্ হনুমান এই মোকা পেয়েছিলেন—গন্ধমাদন-বহনের সময় কিন্তু তিনি—তিনিও যতই বোকা হন, হাতছাড়া করতে পারেননি।