দিগম্বর–না, কী ওর নাম—ওকে দেখলে মনে হয়, ও যেন দৈববাণী শুনছে। স্বকর্ণেই শ্রবণ করছে! ফেরারী সত্য যুগ ফিরে এল নাকি ফের? সেই যে-যুগ—যে কালে, আপনি আসিয়া ভক্তরণস্থলে সংগ্রাম করিত দেবতাগণ!–পুনরায় দেখা দিল। নাকি আবার?
আর হেনাকে দেখলে মনে হয়, অপ্রত্যাশিত এই আবির্ভাবে, এহেন অভাবিত সাক্ষীর অভ্যুদয়ে, ও যেন আস্তে আস্তে আমার ওপরে আস্থা স্থাপন করতে শুরু করেছে।
ওঁর মতো একটি লোককে ঐ বালির গাদাটার পাশে আপনি দেখেছিলেন আজ সকালে? হেনা জিজ্ঞেস করে আমায়।
অবিকল। আর, দেখা মানে? আমরা দুজনে একই সমুদ্রে হাবুডুবু খেয়েছি। একই সুষমাময় সমুদ্রে। সত্যিই, অবাক কাণ্ড। দুজনে একেবারে হুবহু। একটু দূর থেকে দেখলে আলাদা করার উপায় নেই। যাক, কিছু মনে করবেন না মশাই, সামুদ্রিক সুষমায় যিনি মত্ত হয়েছিলেন, তিনি আপনি নন। তিনি অপর কেউ। এখন দয়া করে নিজগুণে আমায় মার্জনা করুন।
ছেলেটি আমায় মার্জনা করে দিল অম্লানবদনে, তৎক্ষণাৎ! তার মুখ দেখেই আমি টের পেলাম।
হোলো তো। দেখলে তো। বলছিলুম না যে আমি নই—সে যেই হোক্, সে কখনো তোমার স্বামী নয়–
চলে যায় ওরা, মেয়েটিকে কাটা কাটা কথা শোনাতে শোনাতে যায় ছেলেটি : সেই লোকটাই আসল বদ। সেই হচ্ছে আসামী। আর দূরবীনধারী সমুদ্রের সেই সুষমাদর্শনকারী হতচ্ছাড়াটা হচ্ছে তার মাস্তুত ভাই। সে লোকটাও কম পাজি না। সেই তো যতো নষ্টের গোড়া। সেই হতভাগাটা যদি না তোমাকে দূরবীন দিতো—যাগ গে, দিগ গে, তাকে কী। এখন, তাকে কি, তার মাস্তুত ভাই সেই সন্তরণবিলাসীকে তোমার স্বামী বলতে চাও? ইচ্ছে হয়, বলতে পারো।… বলতে বলতে চলে যায় ওরা।
আমি হাসি। একখানা স্বর্গীয় হাসি হেসে দিই। দুঃখ-জৰ্জর পার্থিব কোনো জীবের একটুও উপকারে লেগেছি,—একটাও ক্ষণভঙ্গুর সুখনীড়কে ভগ্নদশা থেকে বাঁচাতে পেরেছি–অকিঞ্চিৎকর এই জীবনের যৎকিঞ্চিৎ যাতনাও করতে পারা গেছে—এই ভেবে বিজাতীয় আনন্দ হতে থাকে।
ফেরা যাক্ এবার।
ফিরতেই দেখি, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে কল্পনা। মূর্তিমতী শ্রীময়ী স্বয়ং–
ঠোঁটে ঠোঁটে জমাট লেগে সারা মুখ সুকঠিন—দুই চোখে ওর গনগনে আগুন। একটু আগে হেনার মুখে যে-ছবি দেখেছিলাম তারই পুনর্মুদ্রণ। কিন্তু তার চেয়ে আরো ভয়াবহ।
এই বুঝি তোমার মন্দির দেখতে যাওয়া? আজ সকালে সারা বেলাটা—এই–এই বুঝি?…এই করেই বুঝি…?
দলিতা ফণিনীর মতো কল্পনা ফোস ফোস করে। গর্জে গর্জে উঠতে থাকে ক্ষণে ক্ষণে।
আর আমি?…
কল্পনার কাছে এখনো কৈফিয়ত দিতে হচ্ছে।…
৬. একটু চা না হলে তো বাঁচিনে
একটু চা না হলে তো বাঁচিনে! কল্পনা দীর্ঘনিঃশ্বাসের দ্বারা বক্তব্যটা বিশদ করল।
চা-বিহনে মারা যাচ্ছি এমন কথা আমি বলতে পারিনে –সত্যনিষ্ঠার প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলতে হয় : তবে এক কাপ পেলে এখন মন্দ হেতো না নেহাত!
চায়ের একটা দোকান কাছাকাছি আছে কোথাও নিশ্চয়।
আমারও তাই ধারণা। চায়ের গন্ধ পাচ্ছি যেন! মিনিট খানেকের মধ্যেই কোনো চায়ের আড্ডার ওপরে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারি মনে হচ্ছে।
কিন্তু মিনিটের পর মিনিট কেটে যায়, অগুনতি মিনিট, এবং হোঁচটও বড়ো কম খাইনে, কিন্তু কোনো চাখানার চৌকাঠে নয়। আমি হতাশ হয়ে পড়ি এবং কল্পনা পেঁয়ো লোকের বোকামি আর ব্যবসাবুদ্ধিহীনতার প্রতি তীব্র কটাক্ষপাত না করে পারে না।
বাস্তবিক, গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে যাচ্ছি অথচ চায়ের নামগন্ধ নেই। কেন, গাঁয়ে গাঁয়ে চায়ের দোকান খুললে কী ক্ষতি ছিল? ফলাও কারবারে দু পয়সা উপায় হতে বইতো নয়! এই তো, আমরাই তো দু কাপ খেতাম। ডবল দামেই খেতে পারতাম। এমনকি, চারগুণ দাম দিতেও পেছপা ছিলাম না—চা-র এমনি গুণ।
কিন্তু এই গেয়ো লোকগুলো—একালে বাস করেও সেকেলে—সেসব কিছু বোঝে কি? যাতে দু পয়সা সাশ্রয় নগদা-নগদি আমদানি, তাতেই ওরা নারাজ।
নাঃ, এখনকার কারু দূরদৃষ্টি নেই। কেন যে লোক মরতে আসে এখানে? বেড়াবার কি আর–
কথাটা কল্পনাকে কটাক্ষ করেই বলা। পল্লী অঞ্চলে, পল্লী মায়ের আঁচলে হাওয়া খাবার সখ ওরই উথলে উঠেছিল হঠাৎ। এবং বলতে কি, যে-আমি এমন কলকাতাসক্ত, যাকে কলকাতার বাইরে টানা ভারী শক্ত ব্যাপার, প্রাণ গেলেও পাড়াগাঁর দিকে পা বাড়াইনে—সেই আমাকে একরকম তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে যাদুরে।
–আর জায়গা পায় না? বাক্যটাকে উপসংহারে নিয়ে আসি। এবং বলতে, বলতে, পাড়াগাঁ-সুলভ-আরেক নম্বরের দূরদৃষ্টিহীনতা—পথভ্রষ্ট এক গাদা গোবরের ওপর পদক্ষেপ করে বসি। ঠিক বসিনি—তবে আরেকটু হলেই বসে পড়তে হতো, চাইকি ধরাশায়ী হওয়াও বিচিত্র ছিল না, কিন্তু হাতের কাছাকাছি কল্পনাকে পেয়ে পেয়ে গিয়ে, তক্ষুনি তাকে পাকড়ে, নড়বোড় করে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে গেছি।
তোমার যে বাপু অদূরদৃষ্টিও নেই। বিরস-বদনে কল্পনা বলে। স্বামীর আশ্রয়স্থল হয়েও সে সুখী নয়। তার ব্লাউজের একটা ধার নাকি ফ্যাঁ—স করে গেছে।
ব্লাউজ উদ্ভিন্ন হওয়ার দুঃখ আমার মনে স্থান পায় না। আমার আত্মরক্ষাতেই আমি খুশি। তাছাড়া ভেবে দেখলে, কে কার? রাউজ তো আমার নয়। এবং ব্লাউজ ইত্যাদি বিসর্জন দিয়েও স্বামীরত্নদের যদি অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচানো যায় (সাধ্বীদের অসাধ্যি কী আছে?) তা কি স্ত্রীজাতির কর্তব্য না?
বা রে। তুমি কি বলতে চাও যে আমি ইচ্ছে করে পড়তে গেছি? মানে, ঐ গোবরটার সঙ্গে চক্রান্ত করে–? ক্ষুব্ধ কণ্ঠে আমি বলি : এই কথা তুমি বলতে চাও?