কিন্তু এত বড়ো সাক্ষ্যেও হেনা অটল,–হেনা হেলে না : তুমি কী বলতে চাও শুনি? পোস্টাফিসের ফেরতা এই পথে যেতে যেতে নিজের চোখে আমি কী দেখলাম তাহলে? ঠিক ওইখানটায়, ওই অতো দূরে, উঁচু ঐ বালির গাদাটার কাছে তুমি, আর তোমার চার পাশে একপাল–কী বলবো? একপাল জন্তু!
ছিঃ, হেনা, নিজের স্বজাতির নিন্দে কোরো না। ছেলেটি একটু ক্ষুন্ন হয় : নারীজাতির অবমাননা করতে নেই।
জন্তু না তো কী! কী বলব তাদের? বেহায়া মেয়ে যতো। হি হি হি শুনেই আমি থমকে দাঁড়িয়েছি! দেখলাম গুচ্ছের ছুঁড়ির মাঝখানে স্বয়ং আমাদের মূর্তিমান! আর কী দাপাদাপি বাপরে। কী লাগিয়েছিল ওরা? নটির পূজা, না, ঘোড়ার নাচ!
এখান থেকে ওই বালির গাদাটা কতোটা দূর! এখান থেকে দেখলে কিছুতেই তুমি আমাকে চিনতে পারতে না আর আমিও তোমাকে দেখতে পেতুম—মানে–যদি সত্যি সত্যিই ওখানে আমি থাকতুম সেই কথাই বলছি–
সেটা ভগবানের দয়া, কাছেই এখানে একটি ভদ্রলোক দুরবীণ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন,-সমুদ্রের সুষমা দেখছিলেন তাই যেন বল্লেন,—তার হাত থেকে যন্তরটা একটুখানির জন্যে চেয়ে নিয়ে তার ভেতর দিয়ে তাকালুম। দেখতে আর কিছুই বাকী রইলো না। বলি, সুষমা বলে কেউ ছিল না কি ওদের মধ্যে? যে মেয়েটিকে তুমি হাত কলমে সাঁতার শেখাচ্ছিলে তিনিই সেই সামুদ্রিক সুষমা নন্ তো!
জীবনে আমি কক্ষনো কোনো সুষমাকে সাঁতার শেখাইনি। ছেলেটি প্রতিবাদ না করে পারে না। মেয়েদের নিয়ে সাঁতার কাটা আমার অভ্যেস নয়!
উঃ, কী বাহাদুরী মাইরি! তুমি নিজে গায়ে পড়ে মেয়েটাকে সাঁতার শেখাতে গেলে। আর শেখানো বলে, শেখানো! ইস্!–
সাঁতারেব আমি কী জানি যে শেখাবো! ছেলেটি বাধা দিয়ে বলে! অসঙ্কোচে নিজের অজ্ঞতা জাহির করতে কিছুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করে না।
তাই তো বলচি, আশ্চর্য! আর শেখাতে গেলে সেই ধিঙ্গিকে যে তোমাকেই শিখিয়ে দিতে পারে! যে তার একটু আগেই আধখানা সমুদ্দুর সাঁতরে এসেছে!–
আমি বার বার বলচি আমি নই, আর কেউ। ছেলেটি মুখ চুণ করে জানায়ঃ তুমি কি বলতে চাও যে আমি ছাড়া আমার মতো লোক আর একটিও এই পৃথিবীতে নেই? তোমার মতো আর একটা হা! তোমার জোড়া আর একটি মিললে হয়!
এক বাক্যে মেয়েটি ওকে উড়িয়ে দেয়। ওর সুচিন্তিত প্রস্তাব সমেত ওকে।
বেশ বুঝতে পারছি আমি আর অদ্বিতীয় নই! যেমন, আমাদের হিটলারের থাকে মেনি আমারও হয়েছে। আমারও জীবন্ত প্রতিমূর্তি হবহু প্রতিচ্ছবি, এই পুবীবই কোনোখানে ঘাপটি মেরে আছে নিশ্চয়। সেই হতভাগাই আমার সর্বনাশ সাধন করেছে, আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি!—ছেলেটি দীর্ঘনিঃশ্বাসের সাথে সাথে অবশেষে পরিত্যাগ করে তাকে দেখতে পেলে একবার আমি দেখে নিতাম।
তাই নাকি? হেনাও চলকে ওঠে: আমিও দেখতুম একবার।
হেনার বারংবার ছেলেটিকে হেনস্থা আমার হৃদয়ে—আমার অ্যানাটমির সব চেযে দুর্বল জায়গায় আঘাত হানছিল। স্বামীজাতিসুলভ সমবেদনায় আমি কানায় কানায় ভবে উঠেছিলাম। ভাববা দিকি, এই ছেলেটি না হয়ে যদি আমি স্বয়ং কল্পনার খপ্পরে এভাবে ধরা পড়তুম–কী হতো তাহলে? কল্পনা করতেই আমি শিউরে উঠি।
জীবনে কদাচ কাউকে উদ্ধার করার সুযোগ পাইনি। আমার সামনে কেউ জলে ডুবে মরেনি, আমার কাছাকাছি বাড়িতে আগুন লাগেনি কখনো–আমার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। স্ত্রী-পীড়িত এই অসহায় গোবেচারিকে বাঁচানো যায় কিনা, ভেবে দেখি।
ওদের অলক্ষ্যে উঠে যাই। তারপর হাওয়া খাওয়ার ছলনায় এধারে ওধারে ঘুরে ফিরে বেড়াতে বেড়াতে, পায়চারির ফাঁকতালে ওদের কাছাকাছি এসে পড়ি—তখনো দুজনের মধ্যে ঘোরতর লড়াই।
সাহস সঞ্চয় করে নিই আমি। তারপর সহাস্য মুখ তুলি :
এই যে, এই যে। দিগম্বরবাবু যে! আমি উছলে উঠি অকস্মাৎ : ফের আমাদের দেখা হলো, আঁ?—বলতে না বলতে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ হয়ে পড়ি আমি–আজকেই আরেকবার। কী ভাগ্যি।
দিগম্বরের গলার ভেতরটা ঘড় ঘড় করে ওঠে।
আজ্ঞে—আজ্ঞে, মাপ করবেন। ছেলেটি বলে: আমি—আমি তো আপনাকে–আমার নাম দিগম্বর নয়।।
দিগম্বর নয়? সে কি মশাই, আজ সকালেই আপনি বললেন, আপনার নাম দিগম্বর? আর এর মধ্যেই নিজের নাম ভুলে গেলেন?
সকালে কখন আপনার সঙ্গে আমার দেখা হলো? দিগম্বর যেন দিগন্ত থেকে পড়লো।
আলবৎ হয়েছে। ঐ যে ঐখানে—ঐ——ঐ বালির গাদাটার পাশে? মনে পড়ছে আপনার? একদম না।
একদম না। ঐ বিচ্ছিরি গাদাটার ত্রিসীমানায় আমি ছিলাম না। দিগম্বর বিরসমুখে জবাব দেয়।
সে কি মশাই? এ-বেলায় ও-বেলায় ভুলে যানে। আমি সে-সময় মেয়েদের সাঁতার শেখাচ্ছিলাম, আপনি অযাচিতভাবে এগিয়ে এসে আমার কাজে কতখানি সাহায্য করলেন। কেন মশাই, সেই মেয়েটিকে–সমুদ্রের সুষমাকে—আপনিই তো স্বহস্তে সাঁতার শেখালেন, বলতে গেলে।–
বলতে বলতে আমি আরো কাছে এগিয়ে যাই, আরো তীব্র দৃষ্টিতে তাকাই, আরো তীক্ষ্ণতর কটাক্ষে ভদ্রলোকের আগাপাশতলা বিদ্ধ করি।
হ্যাঁ, আপনিই তো। সুষমার সমুদ্রে আপনাকেই তো তলিয়ে যেতে দেখেছি। ভালো করে অবলোকন করে অবশেষে বিহ্বল হতে হয : আশ্চর্য।…আমার বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রের সঙ্গে আমার কিংকর্তব্যবিমূঢ় কণ্ঠ সমান তালে পাল্লা দ্যায় : তাই তো। আপনি তো দিগম্বর নন। উঁহু, দিগম্বরবাবু তো নন আপনি! এখন দেখতে পাচ্ছি! স্পষ্টই দেখছি এখন! কিন্তু কী অদ্ভুত মিল মশাই! এমন বিস্ময়কর সৌসাদৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। আশ্চর্য!