কিন্তু কেন বলা যায় না, কাঁচা পেয়ারা থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেক ভালো জিনিসই আমার কাছে তেমন পেয়ারের নয়! ধাতে কেমন বরদাস্ত হয় না, কোথায় গিয়ে যেন কামড়ায়! অস্তাচলগামী সূর্যের পরাক্রমে পরাস্ত হয়ে, আত্মরক্ষার খাতিরে সমুদ্রকে আড়াল করে খবরের কাগজের আড়ালে আমাকে আশ্রয় নিতে হয়েছে।
এই একটু আগে, এক জোড়া তরুণ-তরুণী আমার কাছাকাছি এসে কলহ জুড়ে দিয়েছিল—সূর্যাস্ত-দর্শনে তাদেরও সমান অরুচি দেখতে পেলাম—বকতে বকতে তাদের আলোচনার এবং আমার সীমান্তে এসে তারা পৌঁচেছিল। মুখে কাগজ চাপা দিয়ে আমি অকাতরে ঘুমোচ্চি তারা ধরে নিয়েছিল মনে হয়। ঘুমের ভাণ করে তাদের তর্ক করতে দেব, না, নড়ে চড়ে তাদের সতর্ক করে দেব–কোনটা ঠিক হবে সেই কথাই আমি ভাবছিলাম।
আবার তুমি না করচ! আমার নিজের চোখে দেখা। মেয়েটি বলছিল।
কিছুতেই তুমি দেখতে পারো না! প্রতিবাদ করে ছেলেটি : আমি ছিলামই না সে তল্লাটে! তোমার দিব্যি, তার ত্রিসীমানায় আমি ছিলাম না।
আমি নিজের চোখে দেখেছি! বলছি আমি। মেয়েটির ধারালো অনু-যোগ!-–আমি কি মিথ্যে বলছি?
দ্যাখো হেনা, আমার মনে হয় ডাক্তারকে দিয়ে তোমার চোখটা একবার দেখানো দরকার ভালো করে। তুমি আরেকবার এইরকম ভুল করেছিলে মনে আছে বোধহয়? সেই যেবার তুমি এমনি নিজের চোখে দেখেছিলে তোমার কোন্ এক বন্ধুকে নিয়ে আমি লাইটহাউসে ঢুকছি। মিনতি না কি যেন তার নাম! নিউ মার্কেট থেকে ফেরার পথে এমনি নিজের চোখেই দেখেছিলে তো! অথচ তুমি বেশ ভালোই জানতে, একটা প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে সারা দুপুর সেদিন আমি মিউজিয়ামেই কাটিয়েছিলাম। তবুও লাইটহাউসে আমাদের প্রবেশলাভ দেখতে তোমার একটুও বাধা হয়নি।
হয়ই নি তো। সেদিনও আমি ভুল দেখিনি! হেনার বরফ-জমানো গলা: সেদিনের কথাও আমি ভুলব না কোনো দিন!
মিনতির সুরে আরো কী যেন বলতে যাচ্ছিল ছেলেটি, কিন্তু হেনার এহেন জবাবের বফি-পাহাড়ে আটকে গিয়ে তার তুষার-গলানো আবেদন গলার মধ্যেই জমাট বেধে যায়।
খবরের কাগজের ম্যাজিনো-লাইন একটু ফাঁক করে যুধ্যমান দম্পতির দিকে একবার আমি উকি মারলাম। অগ্নিবর্ষিণী মেয়েটি দেখতে মন্দ নয়—তম্বীও বটে, বহ্নিও বটে! রোষকষায়িত হওয়ায় আরো যেন সুন্দরীই দেখাচ্ছিল ওকে। শানানো ছুরিব মত চকচকে আর ধারালো! যে কোনো মেষশাবকই ওর তলায় গলা পাততে দ্বিধা করবে না। কাগজের আড়াল দিয়ে আড় চোখে সেই আরক্তিম শোভার দিকে তাকাচ্ছিলাম–রঙদার আকাশকে উপেক্ষা করে সামুদ্রিক সূর্যাস্তের দিকে ভ্রুক্ষেপমাত্র না করে। সত্যি, অস্তায়মান সূর্যের ওপরেও টেক্কা মেরেছিলো মেয়েটা।
স্বামী হতভাগ্যের আর কী বর্ণনা দেব? রস, কষ, বর্ণ, গন্ধ যাওবা ছিল বেচাবীর, এই অভাবিত আকস্মিক আক্রমণে সমস্তই হাওয়া কোন দিক দিয়ে যে এই ব্লিংসক্রিগ ঠেকাবে, কোণঠেসা হয়ে খেই পাচ্ছে না! বিপন্ন বিপর্যস্ত জীবটির প্রতি অযাচিতই আমার সহানুভূতির উদ্রেক হতে থাকে।
তুমি সুমুদ্দুরে স্নান করতে গেছ সেজন্যে তোমাকে আমি কিছু বলছি না, আমাকে ফেলে একলা যাওয়ার জন্যেও না, কিন্তু কিন্তু অমন করে মিথ্যে কথা বানিয়ে আমাকে ঠকাতে চাওয়ার মানে?…
হেনার ভেতর থেকে চাড়ে-ভাঙা বরফের টুকরোগুলো ঠিকরে ঠিকরে বেরয়।
আমি তোমাকে একশো বার বলেছি, আবার বলছি, আজ আমি সমুদ্রের ধারে কাছেও যাইনি। স্নানই করিনি আজ! শপথ করে বলচি, সারা সকালটা আজ আমি শ্রীমন্দিরের কারুকার্য দেখে কাটিয়েছি,–তোমার তোমার শ্রীজগন্নাথের শপথ!
মনে মনে হাসলাম। সত্যি বলতে, আমি নিজেই আজ সমুদয় প্রাতঃকালটা মন্দির-গাত্রের সুচারু ফার্যে নিবিষ্ট ছিলাম এবং আমাদের—আমার এবং মন্দিরের এক মাইলের মধ্যেও এই মিথ্যাবাদীর টিকি আমার নজরে পড়েনি। অবশ্যি, মন্দির-পৃষ্ঠের কারু ভাস্কর্যের প্রতি ছেলেটির অরুচি থাকবার কথা নয়। ওই সব পৌরাণিক চারু-শিল্প থেকে আধুনিক কলানৈপুণ্য লাভের সুযোগ আছে। এমনকি, উভয়ের অনুত মিলও দেখা যায়। আধুনিকতা আর পৌরাণিকতা এই শ্রীক্ষেত্রে একই সঙ্গমে এসে অকেশে যেন মিশ খেয়েছে। এই কারণে পুরী এলে আর সুযোগ পেলে অনেকে আগে মন্দিরদান করে, এমনকি মন্দির দেখলে জগন্নাথদর্শন পর্যন্ত ভুলে যায়। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব আর যত্নতত্ত্বের সেই মিলনক্ষেত্রে এই গরমিলের নায়কের শ্রীমুখ আমি দেখিনি।
তুমি বলচ যে সমুদ্রের ধারে-কাছেও যাওনি আজ! বেশ, এই চুপ করলুম, আর আমি জীবনে তোমার সঙ্গে কথা বলব না বলতে বলতে ভাবাবেগে আপনা থেকেই হেনার কণ্ঠরোধ হয়ে আসে।
দ্যাখো হেনা, সারা দুপুর আজ তুমি আমার সঙ্গে কথা কওনি, সমশুক্ষণ মুখ ভার করেছিলে তাতে আমি প্রাণে কী ব্যথা পেয়েছি, তুমি জানো না। তারপর সেই তখন থেকে, বিকেল থেকে, তুমি আমাকে কী না বলছ,যা নয় তাই বলছ কিন্তু সব আমি সহ্য করেছি। এরপর ফের যদি তুমি এ-জীবনে আমার সঙ্গে কথা না বলো—জীবনের মতো কথা বলা বন্ধ করে দাও—তাহলে আমি কতদূর মর্মাহত হবো——কিরকম ঘাবড়ে যাবো তা কি তুমি ভাবতে পেরেচ? হেনা, তোমার পায়ে পড়ি, অতটা নিষ্ঠুর তুমি হয়ো না।
স্বামীর সকাতর প্রার্থনায় হেনা তক্ষুণি তক্ষুণি প্রতিজ্ঞা ভাঙলো :
আমি তাহলে বানিয়ে বানিয়ে বলচি এই কথাই তুমি বলতে চাও?
হেনার মুখে ঘুরে ফিরে সেই এক কথা-শব্দভেদী একাঘ্নী! ছেলেটির কপালে পর পর অনেকগুলি রেখা পড়ে তুমি খালি খালি আমায় অবিশ্বাস করচ, হেনা! এই সমুদ্রের সামনে আমি দিব্যি গেলে বলচি, কক্ষণো আজ আমি ওর জলস্পর্শও করিনি, তোমার ওই সমুদ্দুর সাক্ষী!