একদম তুমি আঁচতে পারেনি? বলো কী? বিন্দুবিসর্গও না? আচ্ছা আহম্ম তো! তোমরা কি ভেবেছিলে যে জলপাইগুড়ির জোয়াল থেকে এক হপ্তার এই মুক্তি রিশড়ের মাঠে মারবার জন্যেই আমি ক্ষেপে রয়েছি? যেকালে কি না নিষ্প্রদীপের স্বল্প আলোকে কলিকাতা মহানগরী আরো ঢের রহস্যময়ী হয়ে বাহু বাড়িয়ে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন? তুমি দেখছি একটি নির্জলা বোক্চৈতন!
তাহলে এত কাণ্ড করে এই সব বাগানপাটির মানে? এসব ঠিকঠাক করার উদ্দেশ্য?
উদ্দেশ্য আছে বইকি বন্ধু! গোবিন্দকে আমার পথ থেকে রানো। যাতে আমি অবাধে তটিনীকে নিয়ে বয়ে যেতে পারি। একটু বোকা যদিও, গোবিন্দটা লোক মন্দ না। কিন্তু একটা ওর মহন্দোষ, তটিনীর ওপরে ঝোঁক। ওরও ঝোঁক। এইটেতেই ওকে মাটি করছে। এইহপ্তাখানেকের ছুটির সুযোগে ওর আড়ালে তটিনীর সঙ্গে একটা পাকাপাকি করে ফেলার আমার মতলব ছিল। ভেবেছিলাম, গোবিন্দটা যখন তোমাদের সঙ্গে রিশড়ের মাটি চষবে, সেই ফাঁকে আমি তটিনীকে নিয়ে, চাই কি, গোধূলি লগ্নে একেবারে স্থ হয়েও যেতে পারি। এই সব কারণেই, গোবিন্দকে সরানোর দরকার ছিল আমার। তোমরা যে আমার এত বড় একটা উপকার করে তার জন্য আমি চরিতার্থ—চিরকৃতজ্ঞ। গোবিন্দকে হটাবার জন্যে তোমাদের অজএ-অজ
টেলিফোনের পরপার থেকে ওর ধন্যবাদমুখরতা উদ্বেল হয়ে ভেসে আসে। সমস্তটা আমি নীরবে হজম করি, জীর্ণ করতে বেশ একটু লাগে বৈ কি! তারপরে ভেঁকুর তুলে বলি:
তাহলে এই কটা দিন বেশ ফুর্তিতেই কেটেছে, কী বলে? মতলবও হাসিল নিশ্চয়? তটিনী, তুমি আর গোধূলি—তিনজনে মিলে হলে ত্রিবেণীসম বাধিয়ে ফেলে, আশা করি?
নাঃ, দুঃখের কথা বলব কী তাই? দুঃখের সঙ্গে সুচিত্র জানায়: ট্রেন থেকে শেয়ালদায় নেমেই, ফোন করে খবর পেলাম, তটিনী কোথায় নাকি কয়েকদিনের জন্যে উধাও হয়েছে–এর কোন মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গেছে নাকি কোথায়! ওর বাড়ি থেকেই বললে। কিন্তু কোথায় যে গেছে বাড়ির কারু জানা নেই। মেয়েটার নামও কেউ বলতে পারল না। কী করি, কোথায় কোথায় আর কার কার সঙ্গে যে ও যেতে পারে তার তালিকা নিয়ে খোঁজাখুঁজি করে ওকে খুঁজে বার করতেই গোটা হপ্তাটা আমার ছাওয়া হয়ে গেল।
বার করতে পেরেছে তো? আমি বলি: গোধূলিকেও শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পেরেই নিশ্চয়?
উঁহুঃ! বিদীর্ণ কণ্ঠস্বর সুচিত্রর।–গোধূলির যথাটা বার বার বোলো না, প্রাণে ব্যথা পাচ্ছি। অনেক মাইল লম্বা ওর দীর্ঘনিঃশ্বাস আমার কানে লাগে।
আহা, আমাদের রিশড়ের বাগানবাড়িতে মেও আসতে যদি একবার—আমিও সখেদে বলি : —এসে পড়তে যদি।
য়্যাঁ? তার মানে?
অবিশ্যি, তুমি না আসায় গোবিন্দ আর তটিনীর যে বিশেষ অসুবিধা হয়েছে একথা আমি বলতে পারব না—
বলছ কী তুমি? সুচিত্র বাধা দিয়ে বলে। ওর সূচীভেদ্য স্বর যেন বিঁধতে থাকে আমায়।
তটিনীর প্রতি তোমার টানের কথা তো কল্পনা জানে। ওকে নেমন্তন্ন করাব কথা বলতে তুমি হয়ত ভুলে গেছ এই ভেবে সে নিজের থেকেই তটিনীকে ডাকিয়ে এনেছিল। এবং তারপরে এই দিন সাতেক—এতগুলি দিনের একান্ত আওতায়—তটিনী কোন খাতে যে বয়ে গেছেন, যাক গে,—যেতে দাও, পরচর্চায় লাভ কী? ওসব পরে কথায় পরীর কথায় আমাদের কাজ কি ভায়া–
রিসিভার নামিয়ে রেখে, বালিস ঘাড়ে, কম্বল গায়ে, নড়বড় করতে করতে, আমাব ইজিচেয়ারে, গরম জলের বোতলদের পাশে, গেলাসের সেই ক্বাথের কাছে আবার এসে কাত হই।
ভেবে দেখলে, প্রেমের ফাঁদ তো চারধারেই পাতা–ভূমণ্ডলের কোথায় নেই? যথাস্থানে আর উপস্থিত মুহূর্তে, বোকার মত, ধরা দিলেই হয়। তা না করে বিধাতার ওপরে টেক্কা মেরে নিজের চেষ্টায় বিশেষ করে সেই ফাঁদ পাততে গেলে যা হয় তা কোন কাজের হয় না। মাঝখান থেকে পাতানো ফাঁদে অবাঞ্ছনীয় লোকেরা অযাচিতভাবে জড়িত হয়ে, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া এবং মানসী ইত্যাদির অভাবিত মিলনে জর্জরিত হয়ে পড়ে। ইজিচেয়ারে তেরছা হয়ে শুয়ে কঠোপনিষদের এই সব কঠিন তত্ত্ব মানসচক্ষে দর্শন করি।
তবু, তাহলেও, এতক্ষণে অনেকটা ভালো লাগে। ঢের সুস্থ বোধ করি। ঠাণ্ডা যেন বহুৎ কমে গেছে—নিউমোনিয়ার উপসর্গগুলোও যেন এর মধ্যেই উপে যাচ্ছে মনে হয়। আরাম পাই, ক্রমশই চাঙ্গা হতে থাকি।
৫. সমুদ্রের তীরে এমন একটি অপরাহ্নে
সমুদ্রের তীরে, এমন একটি অপরাহ্নে অপর এবং অন্যের কথা মনে ঠাঁই পাই না। প্রত্যহের কোলাহল—প্রতিদিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে এখন আমি হাজার হাজার মাইল দূরে। মাইল না বলে কিলোমিটার বললেই ঠিক হবে বোধ করি—দুটির অবকাশ জীবনের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রাত্যহিক অপমৃত্যু থেকে পলায়ন ছাড়া আর কী?
আমার সামনে অনতিদূরে ওই উত্তাল সমুদ্র—আর চারিধারে ধূসর বালুর ধূধূ বিস্তার! তার মাঝখানে আমার ডেক চেয়ারে আমি আরামে সমাধিস্থ কল্পনা কখন ফিরবে সেই কল্পনাতেই বিভোর হয়ে রয়েছি মনে হয়।
স্বর্গদ্বারে তার এক সখীর সঙ্গে আলাপ করতে সেই যে উনি গেছেন, এখনো ওঁর দেখা নেই। অগত্যা আমি বেচারী কী আর করি? বিরহ-দুঃখে স্রিয়মান হয়ে মুহ্যমান হয়ে মশগুল হয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছি।
সূর্যের ডুব দেবার খুব দেরি নেই। আমিও খবরের কাগজের মধ্যে ডুবে। সমুদ্রে সূর্যাস্ত ওরফে সূর্যাস্তের সমুদ্র শুনেছি দেখবার মতো একটা জিনিস,—দৃশ্যহিসাবে অতিশয় বিরল বলে নাকি! প্রকৃতি-রসিকরাই বলে থাকেন।