সুচিত্রর কার্যপ্রণালী এই বকমই। সম্পূর্ণ নিখুঁৎ। ওস্তাদী হাতের সূচী-শিল্পের মতই সুচাক-সব কিছুই এফোঁড় ওফোড় করে চলে যায়—তার সূচীভেদ্যতার ভেতর কোথাও ফাঁক রাখে না।
প্রথম হিম পড়ছে, ঋতু পবিবর্তনের মুখে এই সময়ে কলকাতার বাইরে পা বাড়ানো কি ঠিক হবে? আমি ইতস্তত কবি? তার ওপরে আমার আবার সদির ধাত।
বেশ, এই শনিবারই আমাকে রিশড়েয় যাওয়া ঠিক হলো দাদা। কল্পনা বলে। হাকিম যেমন হুকুম দিতে বসে আসামীর মুখাপেক্ষা করে না তেমনি অনায়াসে আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে অম্লানবদনে বলে দ্যায়।
বাঃ, লক্ষী মেয়ে, খাসা মেয়ে! চমৎকার মেয়ে তো একেই বলে বাঃ! সুচিত্রর কলকলধ্বনি শুনিঃ বেশ ভালোই হলো। ঐ সাথে তোমরা যদি তরফদারকেও সঙ্গে নাও, আরো ভালো হয় তাহলে। গোবিন্দ আমার প্রাণের বন্ধু, জানে তো? তরফদারকে। নিমন্ত্রণ করতে কি তোমাদের কোনো আপত্তি আছে?
না, না, আপত্তি কিসের? তোমার বন্ধু আসবেন–সে তো সুখের কথাই। কল্পনাই জবাব দেয়।
কিন্তু তার তো আর ছুটি হয়নি—তার কি নিজের কাজকর্ম নেই? আমিই মৃদু আপত্তি জানাই, অবিশ্যি তরফদারের তরফ থেকেই।
গোবিন্দ? সে ক্যাজুয়াল লীভ নিয়ে বাড়িতে বসে আছে। টেলিফোন করে খবর নিয়েছি আমি। এখানে আসবার মুখে একটু আগেই ওকে বাজিয়ে এসেছি।
আহা, যখন এত লোককেই গায়ে পড়ে বাজিয়ে এসেছ, বাদ দাওনি কারুক্ষেই, তখন একটু কষ্ট করে ঐ সাথে আমার ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকেও কেন বাজিয়ে এলে না? দয়া করে আগামী সপ্তাহে যদি কিছু ওভারড্রাফট দিতো আমায়? এতক্ষণে আমারো একটু ঝাঁঝ দেখা দেয়।
তোমার মেজাজটা আজকাল এমন তিরিক্ষে মেরে যাচ্ছে কেন হে? মনে হচ্ছে হাওয়া বদলানোর দরকার। রিশড়েয় কটা দিন কাটিয়ে এলে তোমার উপকার হবে। বলতে বলতে সুচিত্র উঠে পড়ে: আমি চললুম এখন। সেই রিশড়েতেই মিশব তোমাদের সঙ্গে। কেমন?
ঘূর্ণি হাওয়া চলে যাবার পর, ধ্বংসস্তুপে বিমূঢ় হয়ে পড়লেও মানুষ যেমন একটা অবর্ণনীয় স্বস্তি পায়, চারিধারের নষ্টাবশেষের থেকে অবশিষ্ট নিজেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, আমি সেই মানসিক প্রয়াসে লিপ্ত, কল্পনা আমার তন্ময়তায় বাধা দিয়ে বলে
আচ্ছা, হ্যাঁগা, দাদা তটিনীর কোন কথা তুলল না যে? এটা যেমন একটু কেমন-কেমন না?
হয়তো অন্য তটিনীতে পাড়ি জমাচ্ছে আজকাল। আর কোথাও খেয়া বাইছে! দিলেই হলো, খেয়ালী তো!
উহু, তটিনী বলতে দাদা অজ্ঞান। এ হতেই পারে না। তটিনীকেও তাহলে নেমন্তন্ন করা যাক, কী বলো? তাক লাগিয়ে দেয়া যাবে দাদার, কেমন না?
সে কথা মন্দ নয়। আমি বলি। নিস্পৃহ কণ্ঠেই বলি।
ওর বেশি জোরালো সায় দিতে সাহস হয় না আমার, তবু এতক্ষণে, বলতে কি, সত্যিই আমার মন্দ লাগে না। উষর মরুভুমির মাঝখান দিয়ে তটিনী প্রবাহিত হওয়াটা মন্দ কী? অবগাহনের তেমন আশা না থাকলেও—পাড়ে দাঁড়িয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতেই—এমন কী খারাপ? মিশকালো মেঘের রূপালী পাড়রা দেখা দিতে থাকে একে একে—এতক্ষণে।
অবশেষে আগামী সপ্তাহ এল। আমরা এলাম রিশড়েয়। ভবেশের বাগান বাড়িতে। হিমেল হাওয়া এল, হিম আসতে লাগল, ভয়ানক ঠাণ্ডা এসে পড়ল—কিন্তু সুচিত্ৰর আর দেখা নেই।
হিমেল হাওয়ার হাত ধরে সর্দি এল, কাশি এল, আমার পুরাতন হাঁচিরা এসে পড়ল, আধিব্যাধিদের যারা যারা আসবার এই সুযোগে একে একে এসে গেল, কেবল সুচিত্র এল না। অবশেষে আগামী সপ্তাহ কাবার হয়ে আরেক শনিবার ঘুরে এল।
সুচিত্রর একি লীলা? বুঝতে পারছিনে তো। কল্পনাকে আমি প্রশ্ন করি। আমার পায়ের কাছে তিন তিনটে গরম জলের বোতল, গলাগলি করে আমার পায়ের তলায় গড়াগড়ি যাচ্ছে। গলায় উলের কক্ষটার, আর গায়ে জড়াজড়ি যত রাজ্যের লেপ। লেপের ওপরে লেপের প্রলেপ।
ছুটি পায়নি বোধ হয়। কল্পনা সাফাই দিতে চেষ্টা করে।
তাহলেও তার করে জানানো উচিত ছিল তার। জলপাইগুড়িতে জলপাই আছে কি জানিনে, তবে টেলিগ্রাফ অফিস আছে, যদুব আমার জানা।
এখনো তো রয়েছে একটা দিন। কাল হয়ত আসতে পারে। দেখা যাক না।
কিন্তু না, কালও সে এল না। আবার আমরা বাড়ি ফিরে এলাম। সর্দি কাশি হচিরা সাথে সাথে এল, সেই সাথে আরো ঢের খাঁটি জিনিস আমদানির সম্ভাবনা দেখা গেল। আজ্ঞে হ্যাঁ, নিউমোনিয়া পর্যন্ত প্রায় এসে পৌঁছল, কিন্তু আমাদের ওল্ড ম্যানিয়া—সেই আমার শ্যালকরত্ন এল না।
আদা-গোলমরিচ-তেজপাতা-মিশ্রির গরম কাথ পান করছি, সন্ধ্যে হব-হব—এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল।
গেলাসটা নামিয়ে, স্বল জড়িয়ে, দুই বাড়ে দুই বালিশ সম্বল করে খলিত পদে টেলিফোনের জবাব দিতে গেলাম।
কি হে, বোকর! সুচির গলা বলি, আছে কেমন?
কে? সুচিত্র নাকি? কিরকম তোমার ব্যাভার বলো তো? সাত দিন ধরে আমরা সেখানে—আর তোমার দেখা নেই?
আমার দেখা? তার মানে? আমি যে দেখা দেব সে কথা কখন বললুম? সুচিত্রও বিস্মিত গলা বাড়ায়: ওখানে যে আমি যাব কক্ষনো তা তো আমি বলিনি। ঘুণাক্ষরেও না। আমার মতলবটা নিশ্চয়ই তোমরা—তুমি অন্ততঃ—আঁচ করতে পেরেছিলে?
জবাবের হলে কী যেন বলতে যাচ্ছিলাম, বলতে গিয়ে হেঁচে দিলাম। হচিরা পরম্পরায় এসে আমার বাক্যব্যয়ে বাধা দিল—কিন্তু ওর পক্ষে সবই সমান। আমার বক্তব্য বুঝতে তাতে ওর কিছু অসুবিধা হলো না।
ও বললে: বুঝেছি। আর বলতে হবে না। গোবিন্দটা গিয়েছিল?
তরফদার? নিশ্চয়! সে তো অবাক হয়ে গেছে। তুমিই তাকে আহ্বান করে এনে এভাবে বিসর্জন দেবে সে ভাবতে পারেনি। মতলবটা কী ছিল তোমার শুনি।