বাড়ি? বাড়ির খবর? যদুর ভাল হতে হয়। সুচিত্রব একমুখ উত্তর : সত্যি বলতে, বাড়ির কোনো খবর নেই। বহুদিন ধরে পাইনি। তার মানে অবশ্যই যে, খবর ভালোই; খারাপ কিছু হলেই খবর আসত, কিন্তু সেকথা না—
বলতে বলতে সুচিত্র, আমাদের মাঝখানে, আমাদের প্রাপ্তরাশেব মধ্যস্থলে নিজেকে স্থাপিত করে। রাশীকৃত হয়।
আমার সময় বেশি নেই। তোমরা যদি খাওয়া দাওয়ার জন্যে খুব বেশি পীড়াপীড়ি লাগাও তাহলে এক্ষুনি আমায় উঠে পড়তে হবে। ব্রেকফাস্ট সেরেই বেরিয়েছি। সাড়ে আটটার ট্রেন ধরতে হবে আমায় বলতে বলতে ও জাঁকিয়ে বসে।
ওর কথা, সো পেয়ে, কিঞ্চিৎ আশ্বস্তিতে, দুখানা টোসটের অন্দরে একখানা পোচকে সুবিন্যস্ত করে প্রায় মুখে তুলবার মত পরিপাটি করে তুলেচি, সুচিত্ৰ চকিতের মধ্যে হাত বাড়িয়ে সেই টোস্ট আর পোচের হরিহরাত্মাকে আয়ত্তে এনে নিজের অম্লানবদনে পুরে দ্যায়—
বাঃ, তোমার টেষ্ট আছে হে, চকরবতি! বাঃ! রোমন্থনের সাথে সাথে সে জানায়ঃ বাস্তবিক, চক্কোত্তিদের যে রান্নাঘবের সম্রাট বলে সে কি সাধে? চক্কোত্তিরা মুসলমান হলে খাসা বাবুর্চি হতে পারে। এবং এই বলে সে অপরাপর টোস্ট-পোচদের ওপর পরের পর আক্রমণ চালায়। আর বলে যায় : একটা চক্কোত্তি কাটলে দুটো বাবুর্চি বেরয়, কথাটা মিথ্যে নয়।
তোমার সাড়ে আটটার ট্রেন ধরা চাই—বল্লে না—? সুচিত্র এবং দেয়ালঘড়ির দিকে যুগপৎ দৃষ্টি রেখে আমি মনে করিয়ে দিই। স্মরণ না করিয়ে পারিনে।
তার বদলে সাড়ে দশটার ধরলেও ক্ষতি নেই। সুচিত্র বলে।
তবে—আর কি! আমার হতাশ কণ্ঠস্বরে যদুব সাধ্য আনন্দের অভিব্যক্তিদানের প্রয়াস থাকে।
হ্যাঁ, যেজন্যে এসেছি আসল কথাই বলা হয়নি এখনো। সুরু করে সুচিতয় : আপিসের ছুটির কথা জিজ্ঞেস করছিলে না? সেই ছুটির সম্পর্কেই আমার আসা।
তবে যে বল্লে ছুটি পাওনি? পৃষ্ঠদেশের শেষ তৃণ-খণ্ডের জন্য অকাতরে অপেক্ষমান উটের মত আমি ওর উত্তরের প্রতীক্ষা করি। উটপুখের মতন।
এখনো পাইনি বটে, তবে পাবো শীগগিরই। হপ্তাখানেকের ছুটি নেব ভাবছি—এই সামনের হপ্তায়। সুচিত্র অচিরাৎ সব বিশদ করে দেয়। আর সেই কারণেই তোমার কাছে এলাম।
আমার কাছে? আমার কাছে এসে ভুল করেছ ভায়া। আমি ডাক্তার কি কবরেজ নই যে তোমাকে রেডিমেড-সাটিফিকেট দিতে পারব। মেডিকেল সার্টিফিকেট-বিতরণকারী কোনো ডাক্তার কবরেজের সাথে আলাপও নেই আমার। আমার কাছ এসে লাভ?
বিতৃষ্ণ নেত্রে আমার প্রতি দৃকপাত করে ও বলে-কল্পনাকেই বলে : এটা দিনকের দিন এমন হাঁদা হয়ে যাচ্ছে কেন রে? এটাকে তুই এতদিনেও মানুষ করতে পারিসনি দেখছি! একে কাটলে দুটো বোকা হয়। এমন কি, তেমন কায়দা করে কাটতে পারলে তিনখানাও বার করা যায়।
কল্পনা হাসতে থাকে, আমি ঘোঁৎ ঘোঁৎ করি।
অবিশ্যি, ঘোঁৎকারের চেয়েও, কঠোরতর ভাষায় আমি প্রতিবাদ করতে পারতাম, সুচিত্রর সঙ্গে আমার তথাকথিত মধুর সম্বন্ধ কটু-তিক্ত-কষায়ের যে-কোনোটায় রূপান্তরিত করতেও বিশেষ কোনো বাধা ছিল না, উক্ত রসান্তরণে যৎসামান্যই আমার যেত আসত কিন্তু কল্পনার যসিতে আমাকে কাহিল করে দেয়। অগ্রপশ্চাৎ উভয় প্রদেশ থেকে
অতর্কিতভাবে পরের দ্বারা আক্রান্ত হলে খুব পরাক্রান্ত লোকও বেসামাল হয়ে পড়ে।
ছুটি আমার মঞ্জুর হয়েই আছে, সেজন্য কাউকে মাথা ঘামাতে হবে না। বিবস কষ্ঠে ও জানায় সেজন্যে আমি ভাবছিনে। আমি ভাবছি যে ছুটিটা কাটানো যায় কোথায়। সবাই মিলে এই কটা দিন ফুর্তি করে এক সাথে কাটালে কেমন হয় রে খুকি?
খুব ভালো হয় দাদা! কল্পনা উল্লসিত হয়ে ওঠে: উঃ কী আমোদ যে হয় তাহলে!
কি বলগো, মজা হয় না খুব? কল্পনা আমার দিকে তাকায়।
তা–তা একটু হয় বৈকি। আমি চেষ্টা কবে বলি : সুচিত্র যে মজাতে অদ্বিতীয়—কে না জানে?
কিন্তু তোমাদের এখানে এসে কাটাতে আমি চাচ্ছি নে তো।
এখানে না? এতক্ষণে মজ্জমান আমার একটু আমেজ লাগে,—পিঠের তৃণদণ্ড অগাধ জলের তৃণখণ্ড হয়ে দেখা দেয়। অথই জলে ডুবে যাবার মুখে সেই তৃণটি ধরে আমি বলি : দুঃখের কথা! খুবই দুঃখের কথা! তোমার সঙ্গলাত আমাদের পক্ষে যে কতটা গ্রীতিকর তা তুমি জাননা, কিন্তু তাহলেও অন্যায় আসলিন্স ভালো না। ছুটির এই কটা দিন জোর করে আব সবার আলিঙ্গন থেকে ছিনিয়ে তোমাকে আমরা উপভোগ করতে চাইনে। না, কল্পনা, না, ও যখন আমাদের এখানে এসে ছুটিটা কাটাতে রাজি নয়, তখন ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ওকে উপরোধ কোরো না। স্বার্থপরের মত সেটা সত্যিই জবরদস্তি করা হবে।
আমাকে আধখানা কথাও কি কইতে দেবে আগে? বিৰূপ চক্ষের বিষাক্ত চাহনিতে সৃচিত্র আমাকে বিদ্ধ করে : আমি কী মৎলব এঁটেছি তোমাদের বলি তাহলে। আমি বলছিলাম কি, আমরা সবাই মিলে ভবেশদের রিশড়ের ওইখেনে গিয়ে ছুটিটা কাটালে কেমন হয়?
হ্যাঁ, এটা মন্দ আইডিয়া না। কল্পনা সায় দেয়।
ভবেশ আমাদের প্রতিবেশী এবং পরিচিত। রিশড়ের বাড়িটাও আমাদের অচেনা নয়। জানাশোনার মধ্যে বেশ লোক বেছে বেছে ভবেশরা বাগান-বাড়িটা ভাড়া দিয়ে থাকে—অবশ্যি এক আধ হপ্তার কড়ারেই। আমবাও কয়েকবার সেখানে গিয়ে ফুর্তি করে কাটিয়ে এসেছি।
হুম। আমিও মাথা নাড়ি—ভবেশকে বলে দেখব। কী বলে শুনি। আমার ধারণা, আগামী সপ্তাহে ওরা নিজেরাই সেখানে বেড়াতে যাচ্ছে।
যাচ্ছে না। এখানে আসবার পথে ওদের বাড়ি হয়েই এলাম তো। ওকে বাজিয়ে এসেছি।