- বইয়ের নামঃ ভালবাসার অ আ ক খ
- লেখকের নামঃ শিবরাম চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. পা টিপে টিপে আমরা এগুই
সিনেমা হাউসের আড়াল-করা আলোর নামমাত্র আলোর আওতা ছাড়াতেই—একেবারে ঘুটঘুট্টির মধ্যে এসে পড়লাম। শুনলাম, মিনিটখানেক আগেই নাকি এধারের লাইন ফিউজ হয়ে রাস্তার সব বিদ্যুৎ-বাতি নিবে গেছে। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। একটুখানি ফিকে জ্যোৎস্নার আবছায়া থাকলে ভালো হতো,—এক কাস্তে চাঁদের আলো—চাঁদনির ফসল—পৃথিবীর পক্ষে নেহাত কম নয় (দুজনের পক্ষে তো খুবই বেশি!) কিন্তু এই আকস্মিক অমাবস্যায় একেবারেই মেরে দিয়েছে।
তবে এই অন্ধকারই ভালো! এমন ঘুটঘুট্টিই বা মন্দ কী? পা টিপে টিপে পাশাপাশি চলতে ভালোই লাগে। তবে পাশে নিতান্তই নিজের–কী বলে গিয়ে—ইয়ে, এই যা।
একটা খাসা ছবি–দুজনে মিলে উপভোগ করবার এই বেহালা পর্যন্ত আমাদের ঠেলে আসা! ছবিটার টানেই বিশেষ করে। নামজাদা ছবি, কিন্তু কলকাতার বড় বড় সিনেমায় যখন দেখানো হচ্ছিল, তখন ছোটখাটো নানা কাজে জড়িয়ে থেকে দেখা হয়ে ওঠেনি, তারপর আজ হঠাৎ কলকাতার উপকণ্ঠে এর পুনঃপ্রদর্শনীর ঘোষণা দেখে ভাবলুম এ-সুযোগ আর ফস্কানো না!
সুযোগই বলতে হয়! কলকাতায় বাস করে চাঁদের সঙ্গে আমাদের আড়ি। পূর্ণিমা আমাদের চোখে পড়ে না, অমাবস্যাও। চাঁদের বদলে আমরা পেয়েছি বিদ্যুতের চাঁদনি—সস্তার বাজার! হঠাৎ এই রাস্তা-জোড়া বৈদ্যুতিক বিকলতার দৌলতে, অমা-রজনীর রূপটা দেখতে পাওয়া গেল।
এইমাত্র সিনেমা ভেঙেছে, আর–আমরাও ভেঙে পড়েছি! যে অমা-রজনীর অপরূপ উপভোগ্যতা নিয়ে একটু আগেই উদ্বেল হয়ে উঠেছিলাম, এখন তার গর্ভে প্রবেশ করে তার চেহারা দেখেই চমকে উঠতে হলো।
এই সূচীভেদ্য যবনিকা ভেদ করে আজ বাড়ি পৌঁছতে পারব তো? কল্পনাকে বল্লাম : আমার হাত ধরো, নইলে হারিয়ে যাবে।
কল্পনার হাত আমার বাহুর আশ্রয় নেয়, এবং বলতে কি, নিজের ইয়ে হলেও আমার বেশ ইয়েই লাগে। আমি কল্পনাকে, মানে, কল্পনার সেই ভগ্নাংশকে বগলদাবা করে সন্তর্পণে পা বাড়াই। ফুটপাথটা কোন ধারে, ঠিক যে কোনে, পা দিয়ে হাতড়াতে থাকি।।
উঃ, কী অন্ধকার! কল্পনা দম নিয়ে বলে? বিচ্ছিরি! সিনেমার গহ্বর থেকে বার হবার তোড়ে আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছল—ক্ষণেকের জন্যেই। কিন্তু সেই মুহূর্তের মধ্যেই চারিধারের এই আঁধার আরো ঘোরালো আরো ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল বুঝি। অনুভূতিটা, নানান দৃষ্টিকোণ থেকে, নানা ভাবে রোমন্থন করার আগেই কনা আমার বগলে ফিরে এসেছে। ভালো করে হারাবার আগেই আবার আমরা পরস্পরের করতলগত ও কুক্ষিগত হয়ে পড়েছি।
এবং সেজন্যে তেমন দুঃখিত কি? অমাবস্যার অবশ্যম্ভাবী সুযোগে মাধুর্য-কণ্টকিত সম্ভাবনাটা নিতান্তই মাঠে মারা গেল হয়তো? পেয়ে হারাবার এবং হারিয়ে পাবার এই ফাঁকতালে, কল্পনার বদলে, আর একটি মেয়ে, (কল্পনার মতই সুন্দর আর মিষ্টি, কল্পনা করা যাক না!) অপর একটি মেয়ে হস্তগত হয়ে এলে নেহাত মন্দ ছিল না বোধ হয়।
যাক, গতস্য শোচনা নাস্তি, দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলি। না, ঠিক ও-কথাটা বলি না। বলিঃ কতক্ষণ আর! এও সয়ে যাবে—সয়ে আসবে অচিরেই-কতক্ষণের দুর্যোগ।
কিন্তু ওর মধ্যেও অনুশোচনার সুর বেজে ওঠে—যোরালো একটা প্যাঁচ যেন থেকে যায়। মানে, অন্ধকারটা আস্তে আস্তে আমাদের চোখে সয়ে যাবে! সেই কথাই বলছি। অন্ধকারকে পরিষ্কার করে দিতে হয়।
এবং অন্ধকারের অরণ্য ভেদ করে আমরা দুজনে দুঃসাহসের দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়ি।
ওমা–। অকস্মাৎ আমি চেঁচিয়ে উঠি : চারধারেই জল যে। এবার যে গঙ্গা পেরুতে হয়।
অ্যাঁ? কী বলছ? গঙ্গায় এসে পড়লাম নাকি? কল্পনাও আঁৎকে ওঠে।
প্রায় তাই। জলমগ্ন পা-টাকে ফুটপাথের উপকূলে টেনে তুলি : কলকলধ্বনি শুনছ? এখন সাঁতরে পেরুতে হবে।
ইতস্ততঃ-প্রজ্জ্বলিত জোনাকি পোকার আলোয় যতদূর দৃষ্টি চলে, চারিধার জলে জলময়। এই অন্ধকারের অজুহাতে কোন এক রসিক রাস্তার ঘোলাটে জলের উৎস-মুখটা মজা করে খুলে রেখে গেছেন, (সারা কলকাতাকেই তার জলাঞ্জলি দেবার মৎলবে কিনা কে জানে!) তাইতেই এই কলোচ্ছ্বসিত জলোৎসব!
তাহলে কী হবে? কল্পনা আর পা বাড়ায় না।
কী আবার হবে! যুগে যুগে কারা গন্ধমাদন বহন করেছে? আমরাই। চলে এসো।
উহুঁ। সাদর অভ্যর্থনার বিজ্ঞাপনেও ও অবিচলিত।
তবে সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যাক! সেই ভালো।
এই দ্বীপে?
দ্বীপে।
বাঃ, দ্বীপ কাকে বলে তাও জানো না?
জানি বইকি। দ্বীপ হচ্ছে, ফুটপাথের অংশবিশেষ, এমন একটি স্থলভাগ যার চারিধারে জলবেষ্টিত হয়েও–
হয়তো এটা ব-দ্বীপও হতে পারে। কল্পনা ক্রমেই নিজেকে ফাঁপিয়ে তোলে। তাও হতে পারে। আবার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে রাতারাতি যেসব দ্বীপ গজিয়ে ওঠে তার একটা হওয়াও বিচিত্র না! খুব অসম্ভব নয়। আমিও কল্পনার রাশ ছেড়ে দিই। রাশ ছেড়ে দেয়া খুব শক্ত ছিল না। এই সুপরিচিত শহরতলীও অন্ধকারের অপরিচয়-সূত্রে এমন অবাস্তব আর রহস্যময় হয়ে উঠেছিল যে এহেন জগতে এই মুহূর্তে সব কিছুই সম্ভব বলে বোধ হতে থাকে।
আচ্ছা, এই রকম একটা দ্বীপে উৎক্ষিপ্ত হবার বাসনা তুমি মনে মনে কখনো পোষণ করোনি, ঠিক করে বলো তো?
কখনো না। কল্পনার সুদৃঢ় কণ্ঠ : আমার ভারী ঠাণ্ডা লাগছে। আমি বাড়ি যেতে চাই।
ঠাণ্ডা লাগার অপরাধ কি? সাড়ে এগারোটায় সিনেমা ভেঙেছে—এমনিতেই তো