আরে লক্ষ্মী, সব ভাত খেলে, আর চাচার জন্যে–তারপর সে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ উঁচু করিল।
আজহারকে নদীর পাড়ের উপর দেখা গেল। হাত-মুখ, থালা ধোওয়া শেষ হইয়াছে।
নূতন উৎসাহ পায় লোকটা। আরো জোরে গান ধরে সে। কুমড়াক্ষেতের ওপাশে আজহারকে দেখিয়া সে জোরে ডাকে : ও ভাই খাঁ।
নিকটে আসিল আজহার : কে চন্দর?
লোকটা মহেশডাঙার চন্দ্র কোটাল। মাঠেই বসবাস করে সে। ভাড়-নাচের দল আছে তার। ভিন-গাঁ হইতে পর্যন্ত ডাক আসে পূজা-পার্বণের সময়। গাঁয়ের লোকের সঙ্গে তার সম্পর্ক কম। জ্ঞাতিদের সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি করিয়া কয়েক বছর আগে সে পল্লী পরিত্যাগ করিয়াছিল। প্রতিবেশীর নিঃশ্বাস তার ভালো লাগে না। কিন্তু মাঠে সকলের সঙ্গে তার সদ্ভাব খুব। কয়েক বিঘা জমি দূরে তার কুঁড়ে। স্ত্রী এলোকেশী আর একটি মেয়ে সংসারের সম্বল। বহু ঝড়-আপদ গিয়াছে তার উপর দিয়া। বসন্তে একই মাসে দুটি মেয়ে মারা গেল পাঁচবছর পূর্বে। চন্দ্র কোটাল স্ফুর্তিবাজ দিলখোলা লোক। কুঁড়ের পাশে কয়েকটি তালগাছ। আজহারের জমির প্রাঙ্গণ হইতেও তালসারি দেখা যায়। বাঁশ আর তাড়ির ভাঁড় সারাবছর এই গাছে লাগিয়া থাকে। গ্রীষ্মের দিনে চন্দ্র কোটালের মরশুম পড়ে।
ও খাঁ, শিগগির এসো।
চন্দ্র আমজাদের দিকে ফিরিয়া বলে, বুড়ো দাড়িওয়ালা কে?
আমার আব্বা।
কী করে জানো?
চন্দ্র গোঁফে আঙুল চালায় আর মুচকি হাসে।
আমার আব্বা তো। আমি জানিনে!
দূর হইতে সংলাপ কানে যায় আজহার খাঁর। নিকটে আসিয়া বলে, চন্দর, আজ কষে হারাম গিলেছ। খুব-যে গান ধরেছিলে। তৌবা!
এই তো খাঁ–ভাই, তুমিও গাল দেবে?
আজহার খাঁকে চন্দ্র সমীহ করে। সজ্জন ব্যক্তি। তাছাড়া খাঁয়েদের প্রাচীন বংশ মহিমার কাহিনী এই গাঁয়ের সকলের পরিচিত। তার দাম চন্দ্রও দিতে জানে।
মাছ কেমন ধরছ?
চন্দ্রের কুঁড়ের সম্মুখে দুইটি খালের মোহনা। বারোমাস পানি থাকে। বর্ষাকালে চন্দ্র চাষের দিকে ভালো মন দেয় না। মাছে খুব রোজগার হয় তখন। কাঠি-বাড় দিয়া খালের মোহনা ঘিরিয়া রাখে সে।
না ভাই, দিন-কাল ভালো নয়। একটু তামাক দাও।
আজহার খাঁ বাসন-লোটা নিচে রাখিল। কয়েত-বেলের গাছে ঠেস দিয়া সে নারিকেলি হুঁকা রাখিয়াছিল। হাতে তুলিয়া লইল।
আচ্ছা, তামাক খাওয়াচ্ছি, ছেলেটাকে একটা তরমুজ দাও। এ বছর আমার ক্ষেতে নাদারা।
চন্দ্র কোটাল আমজাদের কচি থুতনি হাতের তালুর উপর রাখিয়া জবাব দিল, আরে ব্যাটা, এতক্ষণ আমাকে বলিনি কেন?
উঠিয়া পড়িল চন্দ্র। বিঘে দুই জমির পাড়ি। আবার শিস দিতে লাগিল সে। আনুষঙ্গিক গানও রেহাই পায় না।
জমি বেচে দুয়োর বেচে
গড়িয়ে দেব গয়না।
ডুমুর তলার হলুদ পাড়
আমারে হায় চায় না।
আজহার খাঁ আমজাদকে বলে, পাগল চন্দর।
পুত্র পিতার মন্তব্যে হাসে।
আমাকে এতক্ষণ বলছিল, সব ভাত শেষ করলে, আমার জন্যে রাখলে না?
তুমি কী জবাব দিলে?
কিছু না। চুপচাপ বসেছিলাম। ভয় পেয়েছিল।
আজহার খাঁ হাসে।
পাগল চন্দরকে ভয়ের কিছু নেই। আচ্ছা আসুক।
ফিরিয়া আসিল চন্দ্র কোটাল। শিস দিতে দিতে দুটি বড় তরমুজ মাটির উপর রাখিল। আমজাদের দুই চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হইয়া ওঠে।
আজহার খাঁ বলে, দুটো বড় তরমুজ আনলে কেন?
তাতে কী।
আজ বাদ কাল গঞ্জ। এবার চালান দেবে না?
চন্দ্র ঘাম মুছিতেছিল।
না, এবার চোরে চোরে শেষ। এই হাট ফাঁক গেল।
দুইটি তরমুজ বেশ বড়। একটির রঙ ঘন সবুজ। অপরটি সাদা। মাঝে মাঝে কালো ডোর-টানা, যেন চিতাবাঘের গা।
চন্দ্র কোটাল আঙুলের টোকা দিয়া তরমুজ দুটি পরীক্ষা করিল।
এই সবজে রঙের তরমুজটা খুব পেকেছে। এখনই কাজ চলবে।
চন্দ্র কাস্তের নখ তরমুজের উপর বসাইতে গিয়া থামিয়া গেল। তোমার নাম কী, চাচা?
আমজাদ।
রাগ করো না। আর একটু দাঁড়াও, চাচা।
চন্দ্র আবার উঠিয়া পড়িল। নদীপথের দিকে তার মুখ। বাধা দিল আজহার। সে জিজ্ঞাসা করে, কী হলো চন্দর?
সারাদিন রোদ পেয়েছে, তরমুজ খুব গরম। ছেলেটার খেয়ে আবার শরীর খারাপ করবে।
আজহার ঈষৎ বিরক্ত হয়।
এখন তবে কী করবে?
নদীর হাঁটুজলে বালির তলায় পাঁচ মিনিট রাখলেই, ব্যাস।
একদম বরফ। ব-র-ফ।
আজহার দ্বিরুক্তি করে না। চন্দ্র জমির আল ধরিয়া নদীর দিকে চলিয়া গেল।
আজহার পুত্রের দিকে তাকায়।
দেখলে? চন্দরটা পাগল।
এবার পিতার কথায় আমজাদ সায় দিতে পারে না। সে নদীর দিকে চাহিয়া থাকে।
বড় ভালো লাগে চন্দ্র কোটালকে তার। শাদা ডোর-টানা তরমুজের দিকে সে আর একবার লোভাতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল।
দুই বছর কয়েত-বেল ধরে না। রোজগারের এই একটি পথ বন্ধ হইয়া গিয়াছে। আজহার খাঁ আফসোস করে।
মাঠে এলে, বাবা দুটো বেলও গাছে হয়নি।
আমজাদ এই কথায় কোনো সাড়া দেয় না। সে চন্দ্র কোটালের প্রতীক্ষা করিতেছে। সময় যেন আর শেষ হয় না।
সূর্যের কিরণে দহনসম্ভার নাই। পড়ন্ত বেলার সূচনা আরম্ভ হইয়াছে। ঈষৎশীতল বায়ু কয়েত-বেলের বনে মর্মর তোলে। গাভীদল দোদুল কোকুদে আবার ঘাসের সন্ধানে বাহির হইয়াছে।
এই, তরমুজ ক্ষেতে কে?
নদীর পাড়ে দণ্ডায়মান চন্দ্র। হাতে নদীমাত তরমুজ। টপটপ পানি পড়িতেছে।
আমজাদ আশ্বস্ত হয়।
আজহার তামাক সাজিতেছিল। চন্দ্র নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
এইবার শুরু করা যাক। ফিকফিক হাসে চন্দ্র।