কোটাল বলিল, চাচা, লোকে আর গান শুনতে চায় না। গান গেয়ে পেটের ভাত জোটানো দায়।
মোনাদির বড় নিরাশ হইল। কোটাল নিজেই জানাইল, গ্রামে নিয়মিত কোনো কাজই আর মেলে না।
মোনাদির তাই বলিল, কাকা, আপনি শহরে চলেন। আপনার যা মেহনত করার। ক্ষমতা, চটকলে আপনাকে লুফে নেবে।
সত্যি।
হ্যাঁ। কাকা, আমি মেট’কে বলে আপনার কাজ জুটিয়ে দেব।
বেশ। তুমি কবে যাবে?
পরশু। আমজাদকেও কাজে লাগিয়ে দেব।
বেশ আমিও যাব।
অচেনা জীবনের জন্য কোটালের পরম উৎসাহ। তবু কোটাল একবার স্তব্ধ হইয়া গেল, দিগন্ত বিসারী বিরল তালগাছ ক্ষত মাঠের বুকের দিকে চাহিয়া।
অবেলার আকাশে নীড় সন্ধানী পাখিরা দল বাঁধিয়া অন্ধকারের দিকে অগ্রসর হইতেছে। মেঠো আমেজে কোটাল তন্ময়, কেমন যেন বিষণ্ণতা বুকে।
তবু সে বলিল, চাচা, পরশু কখন বেরুবে? রেল স্টেশনে তিন জনে যাব।
আমজাদ মুনিভা’য়ের সঙ্গে সে দুনিয়ার অপর পিঠে যাইতে প্রস্তুত।
***
গোধূলি নামিয়াছিল।
আবছা অন্ধকারের প্রলেপ এখনই দিকে দিকে ছড়ানো। অস্তাচলের লালিমা নিভিয়া যাইতেছে।
দরিয়াবিবির কবরের পাশে তিনটি ছায়ামূর্তি দণ্ডায়মান। ইহাদের চেনা যায়। মোনাদির, আমজাদ ও কোটাল।
মাথা নিচু করিয়া মোনাদির দাঁড়াইয়া থাকে। দুই চোখ ভরিয়া অশ্রুর প্লাবন। মোনাদির এখন শহরের নাগরিক। গত ছমাসে চটকলে এমন সব মানুষের সন্ধান পাইয়াছে, তাদের ছোঁয়ায় সে চোখে নূতন অঞ্জন পরিয়াছে। এই পৃথিবীর বহু হদিস সে জানে। তবু চক্ষুর পানি আর রোধ করিতে পারে না। তার বুকে চাড়া দিয়া ওঠে বেদনার রাগ রাগিণীর তোড় মুখর ঝঞ্জার। অস্ফুট কণ্ঠে সে বলে, মা গো, তোমার বুকে একটু ঠাই দিও।
মোনাদির হঠাৎ ডুকরাইয়া উঠিল, আবেগ আর রোধ করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য।
কোটাল আগাইয়া আসিয়া বলিল, চাচা, বেটাছেলে, মার জন্য কি এত কাঁদে? আমারও তো মা নেই। চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু চন্দ্র অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল।
অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে সে নিজেও বলিয়া ফেলিল, দরিয়াবিবি, সেলাম… সেলাম…।
দুই বাহুর মধ্যে দুই ভাইকে জড়াইয়া চন্দ্র কোটাল অগ্রসর হইল।
তারা তিন জনে অগ্রসর হইল। চেনা-অচেনা সড়কের দিকে।