দেড় ঘণ্টা কেমন করিয়া কাটিল, বিধাতা হয়ত জানেন।
প্রথম শিশুর অসহায় চিল্কারে ছোট্ট রান্নাঘরটি একবার সচকিত হইল।
মাটির গামলা ও পানি পূর্বেই রাখা ছিল।
দরিয়াবিবি প্রথমে শিশুকে বুকে তুলিয়া লইল। হয়ত তাকে বুকে চাপিয়াই বসিয়া থাকিত। শিশুর চিঙ্কারে খেয়াল হয়। এই সাবধানবাণীর জন্য দরিয়াবিবি বড় কৃতজ্ঞসজল চোখে শিশুর দিকে তাকাইল; তারপর গামলায় গোসলের সব খুঁটিনাটি সম্পন্ন করিল। অতঃপর শয্যার ব্যবস্থা। কয়েকটি রঙিন কাঁথা দরিয়াবিবি বিছাইল ও দুইটি কাঁথা মুড়িয়া নবজাতককে শোয়াইয়া দিল। সে নিজে তখনো দিসনা। তাড়াতাড়ি নিজে পরিষ্কার হইয়া তার নবতম অতিথিকে মাই খুলিয়া দিল। কি সুন্দর চুকচুক শব্দ হয়। কি মোটা তাজা গৌর রঙ শিশু! দরিয়াবিবি উম দিতে থাকে। শিশুর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিতে থাকিতে হঠাৎ কয়েকবিন্দু অশ্রু পড়িল অলক্ষিতে।
বাহিরে শৃগাল প্রহর ডাকিল। দুই পেচক কলহ করিয়া আবার জুড়িকণ্ঠ মিশাইল।
দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল।
নব প্রসূতির দেহে কোথাও কি যন্ত্রণা আছে, দুর্বলতার আক্রমণ আছে? হয়ত নাই। তাই নির্বিকার দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল। উম পাইয়া শিশু ঘুমাইতে লাগিল। সেও কেমন। নির্বিকার। বাহিরের পৃথিবী সুপ্ত। এখানে গ্রাম্য রান্নাঘরের বুকে কি গভীর প্রশান্তি। পুত্র ও জননী পরস্পরের সান্নিধ্যে পৃথিবীকে ভুলিয়া গিয়াছে।
মানুষের পক্ষে বিস্মরণ কি এত সহজ? দৰ্মায় মোরগ বাক দিল। ভোর হইয়া আসিয়াছে। দরিয়াবিবি মনে মনে শুধু ভাবিল, ভোর হয়ে এসেছে। ভালো কথা একটু পরে সকাল হবে।
আবার মোরগ ডাকিল। সাকেরদের পাড়া হইতেও মোরগের আওয়াজ আসিতেছে। আরো ভোর হইল।
শিশুকে শোয়াতে গেলে সে হাত পা নাড়িয়া একটু শিহরিয়া উঠিল, তার কাঁচা ঘুমে। ব্যাঘাত। আবার সে শান্ত হইয়া গেল।
দরিয়াবিবি নবজাতকের দিকে অপলক চাহিয়া, বার কয়েক চুম্বন করিল।
তারপর উঠিয়া পড়িল। শ্লথ গতি নয়, দ্রুত। দরিয়াবিবি কর্তব্যে ঢিলা, কে এমন অপবাদ দিবে?
ভোরের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকিতেছিল চালের বাতার কাছাকাছি ফাঁক দিয়া। তখনো বাহিরে অন্ধকার।
গরুর দড়িগাছি দরিয়াবিবি নিজেই মাচাঙে দাঁড়াইয়া চালে টানাইল। শুধু প্রসূতি, ধাত্রী নয়। আর এক কর্তব্য সম্পাদনা বাকি আছে। দরিয়াবিবি যে জল্লাদ।
শিশুর বিছানায় গিয়া সে দেখিল, পুত্র ঘুমাইতেছে। পুত্র! বেটা ছেলে! কয়েকবার মৃদু চুম্বন দিয়া দরিয়াবিবি উঠিয়া দাঁড়াইল। কুকুটের কি অসীম স্নেহ ও প্রভু ভক্তি। নিজের হাতে ইহাদের দরিয়াবিবি কত খুদ কুঁড়া খাওয়ায় প্রতিদিন। কৃতজ্ঞ প্রাণী ভোরের সানাই বাজাইল।
আর দেরি করা চলে না। দরিয়াবিবি নিজের মনে উচ্চারণ করিল। হঠাৎ আসেকজানের কথা মনে পড়িল তার। বুড়ি চল্লিশা খাইয়া ঘরে ফিরিতেছে, হাতে খাবারের পুঁটলি, লাঠির উপর ভর দিয়া বৃদ্ধা হাঁটিতেছে।…
দড়ির ফাঁসের দিকে দরিয়াবিবি তাকাইল। সারাজীবনে কত উদ্বেগ, কত সংগ্রামজনিত ক্লান্তি ওইখানে ঝুলাইয়া রাখিয়া আজ সে নিশ্চিন্ত হইতে চায়।
তার আগে দরিয়াবিবি ডিপা নিভাইয়া ঘর অন্ধকার করিয়া দিল।
.
৪৫.
রৌদ্র উঠিয়াছিল গাছপালায়, আকাশ ভরিয়া।
মার তাড়া নাই। আমজাদ নঈমা শরী খুব ঘুমাইয়াছিল।
কিন্তু সকালে উঠিয়া আর কেউ বাহিরে আসিতে পারে না। অগত্যা চেঁচামেচি। সাকেরের মা হাসুবৌকে খবর লইতে পাঠাইয়াছিল। সে টাঁটি খুলিয়া দিল।
আবার রান্নাঘরের টাটি বাহির হইতে তাহাকেই কৌশলে খুলিতে হইল। হাসুবৌর প্রথম চোখ পড়িল রঙিন কাঁথার অরণ্যে। সদ্যোজাত ঘুমন্ত শিশু।
তারপর উপরের দিকে চাহিয়া সে চিৎকার করিয়া উঠিল। আতঙ্কিত পরিবেশের মধ্যে সে কাঁথাসহ শিশুটিকে বুকে তুলিয়া লইল আর নামাইল না।
কিছুক্ষণের মধ্যে জনবিরল গ্রামের এই অখ্যাত অঙ্গনটি ক্ষুদ্র জনতায় ভরিয়া উঠিল। আসিল রহিম বখশ, রোহিণী চৌধুরী, চৌকিদার, সাকের, আমিরন চাচি অনেকে। রহিম বখশ, রোহিণী চৌধুরী– যাহাদের পার ধূলা কোনোদিন দীন আজহারের অঙ্গনে পড়ে নাই, তাহারাও আসিয়াছিল। সংসারে প্রতিদিন মৃত্যুর তোরণ যারা সাজাইয়া রাখে, মৃত্যুর প্রতি তাহাদের কৌতূহল বেশি। কৌতূহল মিটাইতে হইবে বৈকি! তাহারা আসিয়াছিলেন।
ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের সার্টিফিকেটেই সব কাজ হইল। থানা পর্যন্ত আর দাঁড়াইল না।
হাসুবৌ শিশুটিকে বুকে করিয়া নিজের ঘরে লইয়া গেল। সাকের প্রথমে আপত্তি করিয়াছিল। কিন্তু হাসুবৌ মরিয়া। তার সুপ্ত অদম্য তেজের মুখে, নিষ্পাপ শিশুর নিরপরাধিতার সাফাই কীর্তনের মুখে সকলের জবরদস্তি উবিয়া গেল।
আমিরন চাচি শরী, আমজাদ ও নঈমাকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিল।
আরো দুই তিন মাস পরে আসিল মোনাদির। চটকলে কাজ লইয়াছে সে। আরো জওয়ান। জঙ্গীভাব চেহারায় স্পষ্ট।
আমিরন চাচি তাহার হাত ধরিয়া হাউমাউ করিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিল। মোনাদির রাজি হইয়াছে : শহরে তার কর্মস্থল, কিন্তু তার আবাসভূমি চিরদিনের জন্য মহেশডাঙায়।
আমজাদকে লইয়া মোনাদির চন্দ্র কোটালের ওখানে গেল। সাত দিনের ছুটি লইয়া আসিয়াছিল। কিন্তু মন আর গ্রাম ছাড়িতে চায় না।
কোটালের কাছে মোনাদির প্রস্তাব করিল, গানের দল করা যায় কি না।