দুঃখী মানুষ দুয়ারে আশ্রয় লইয়াছে। সমস্ত ঘৃণা দরিয়াবিবির মন হইতে মুছিয়া যায়। ইয়াকুবের দিকে সে তাকাইল। গায়ে ঠিকমতো চাদর নাই। পাঁজরের প্রান্ত খোলা! পায়ের দিকে হাঁটুর পরে আর চাদর নাই। খোলা গায়ে জ্বর আরো বাড়িতে পারে?
দরিয়াবিবি ধীরে ধীরে অগ্রসর হইল। জ্বরের উত্তাপ গা ছুঁইয়া বোঝা যাইবে। অতি সন্তর্পণে সে তাপ দেখিল। জ্বর যে খুব, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাই ধীরে ধীরে গাখানি চাঁদরে ঢাকিয়া দিল। তখনো হাত তোলা সম্পূর্ণ হয় নাই, ইয়াকুব চোখ মেলিয়া তাকাইল। বান মাছের গর্ত খুঁজিতে গিয়া যেন হঠাৎ সাপ ঠেকিয়াছে হাতে-দরিয়াবিবি এমনই আতঙ্কিত শিহরণে তাড়াতাড়ি পিছাইয়া দ্রুত কক্ষ হইতে নিষ্ক্রমণের পথ ধরিল ও তাড়াতাড়ি বলিল, তক্তপোষের উপর সাগু রইল, উঠে খেয়ো।
ইয়াকুব চোখ বুজিল, হয়ত পুনর্বার ঘুমাইতে।
.
৪৪.
অসুখ কমিল না।
ইয়াকুবের বাড়ি হইতে লোক আসিয়াছিল খোঁজ লইতে। এখানে ডাক্তার দশ মাইল দূরে থাকে। চিকিৎসার দিকে ইয়াকুবের কোনো খেয়াল ছিল না। বাড়ির লোক ফিরিয়া গেল।
কিন্তু তিন দিন পরে নদীর ঘাট হতে খবর আসিল, আরো লোক আসিয়াছে। ইয়াকুবের এখানে থাকা হইবে না। দুই নৌকা বোঝাই ইয়াকুবের দুই পত্নীই হাজির হইল। গৃহে প্রত্যাবর্তন ছাড়া আর উপায় নাই। তা-ই হইল। ইয়াকুবের অগস্ত্য যাত্রা। ইয়াকুব অসুখে মরে নাই। কিন্তু আর ফিরিল না। মহেশডাঙার পথ সে চিরতরে বন্ধ করিয়া দিয়াছিল।
দরিয়াবিবির চতুর্দিকে অন্ধকারের নৈরাজ্য। অন্ধকারই অন্ধকারের পরিসমাপ্তি ঘটায়। নচেৎ অভ্যস্ত জীবনে মানুষ আনন্দ পাইত কি করিয়া? এই ক্ষেত্রে সেই পথও চিরতরে বন্ধ হইয়া গেল।
দুই-তিন মাস পরেই তিলে তিলে অনটন-উপবাস, উদ্বেগের সড়ক বহিয়া সেই রাত্র আসিল– অন্ধকার যার লীলাভূমি। দরিয়াবিবির এই তমসার যেন প্রয়োজন ছিল। সে সত্যই হাত তুলিয়া আল্লার শোকরিয়া আদায় করিল। ও যদি দিবালোকে আসিত? এত মানুষের সম্মুখে, পুত্র-কন্যার সম্মুখে! তোমার কত মরজি আল্লা। তোমার এই রহমতটুকুর জন্য তোমার কাছে হাজার শোকরিয়া, হাজার মোনাজাত!
গভীর রাত্রের কালো ডানা মহেশডাঙার উপর প্রসারিত। সুপ্তির শাসন দিকে দিকে। নৈশ পাখির দল হয়ত জাগিয়া আছে। আর জাগিয়াছিল দরিয়াবিবি।
ধীর মৃদু বাতাস বহিতেছিল। দরিয়াবিবির হস্তস্থিত প্রদীপের শিখা তাই কম্পমান। দরিয়াবিবি জাগিয়া ছিল, জাগিয়া উঠিল। দাওয়ার উপর ডিপা হাতে দণ্ডায়মান। বাহির হইতে টাঁটির দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছে সে কিছুক্ষণ আগে। আমজাদ, শরী, প্রায়ান্ধ নঈমা– সকলে ঘুমাইতেছে। কান পাতিয়া সে শুনিল শিশু-কিশোরদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ। এইভাবে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়।
দরিয়াবিবি নিঃশ্বাস চাপিয়া ধীরে ধীরে রান্নাঘরের ভিতরে ঢুকিল ও ভিতর হইতে অর্গল বন্ধ করিয়া দিল। মজবুত বাঁধা কি না, তাও একবার টানিয়া দেখিল। তারপর কম্পিত হাতে ডিপা এক জায়গায় নামাইয়া একটি মাদুর পাতিল।
বহুদিন গোপন ছিল। কিন্তু বিকাশের ধারা কোথাও বন্ধ হয় না। সময় শুধু এই একটিমাত্র ক্ষেত্রের অপেক্ষা করে।
দরিয়াবিবির সমস্ত শরীর নাড়া দিতেছে, তবু এতক্ষণ সে মুখে যন্ত্রণার সামান্য কুঞ্চন পর্যন্ত ফেলে নাই। সমস্ত কাজের ভার তার নিজেরই উপর। তার তো কেউ সাহায্যে আসিবে না।– মাদুর পাতিয়া দরিয়াবিবি গায়ের ছেঁড়া কুর্তাখানি ভোলা মাত্র আরো কাপড় বাহির হইল। শরীর ব্যাপিয়া তখন প্রচণ্ড ঝাঁকুনি শুরু হইয়াছে। তাড়াতাড়ি কোমরের কাপড় পর্যন্ত আলগা করিয়া দিল। তখন একরাশ কাপড়, ছেঁড়া ন্যাকড়া, নঈমার ফালি, আমজাদের ছেঁড়া শার্ট–এক স্থূপ বাহির হইল। আসন্নপ্রসবা জননীর স্ফীত উদরখানি প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয় না। আরো অন্ধকারে রহিয়াছে বিশ্বের বিস্ময়তম মানবশিশুর নীড়খানি। দরিয়াবিবির পেটের উপর হাত বুলাইতে লাগিল। হঠাৎ তার মনে পড়িল আমিরন চাচির কথা, বুবুর শরীর যেন ফেটে পড়েছে। আহ, সত্যি যদি ফাটিয়া যাইত-কি সুখই না পাওয়া যাইত। দরিয়াবিবি জোরে একবার প্রশান্তির নিঃশ্বাস লইল। আরো কাজ আছে। উদর অন্ধকারে মুমুক্ষু মানব শিশু যতই আর্তনাদ করুক বাহিরে আসার আকুলতায়, কর্তব্যের ডাকে দরিয়াবিবি সারাজীবন অনড়। আজ তার কোনো নড়চড় হইবে না। ঘুঁটের মাচা হইতে ছোট ছোট বহু কাঁথা দরিয়াবিবি মাদুরের এককোণে রাখিল।
তারপর উবুড় হইয়া সে সমস্ত মাদুর চাপিয়া ধরিল। আহ, এখন শুধু একটু চিৎকারের স্বাধীনতা পাওয়া যাইত। ছেলেরা না জাগিয়া ওঠে। তাই সারাদিন কাহাকেও ঘুমাইতে দেয় নাই। অসহ্য বেদনায় দরিয়াবিবি এই প্রথম মুখ কুঞ্চন করিল। মাদুরে হাত পিছলাইয়া যায়, তাই একটু আগাইয়া সে মাটি আঁকড়াইয়া ধরিল। মাটির কন্যা জননীর আশ্রয় ছাড়া আর কোথায় তাকৎ পাইবে?
দরিয়াবিবি অসহ্য যন্ত্রণায় দিশাহারা হয় না। আগন্তুক অতিথির অসম্মান সে কিরূপে সহ্য করিবে? এত হাত দিয়া পেছনে দেখিতে হয়, সে না হঠাৎ মাটির উপর আছাড় খায়।
দরিয়াবিবির চোখে আর কোনো প্রশ্ন নাই। ত্বরান্বিত হোক, হে আদিম শিশু তোমার আগমন। এত যন্ত্রণার মধ্যে জননী তোমার পথই তো চেয়ে থাকে। কত লজ্জা, কত অপমান ধিক্কার বাহিরের জগতে প্রতীক্ষমাণ, আমি তোমার জন্য প্রতীক্ষমাণ। আপ্ত রমণী মাঝে মাঝে মনের সঙ্গে যোঝযুঝির ক্ষেত্রে কতবার পরাস্ত। আজ বিজয়িনীর মতো দরিয়াবিবি ধাত্রী ও প্রসূতি হইয়া যায় একত্রে। নিজে নিজের শরীরের উপর অসম্ভব ঝাঁকুনি প্রয়োগ করে সে। গৃহস্থের দুলালীর মতো সে তো বহুক্ষণ এই ঘরে পড়িয়া থাকিতে চায় না। প্রসূতি এবং সে আবার ধাত্রী একাধারে। আরো কাজ আছে। কাজ….