দরিয়াবিবির চোখে আর পানি নাই। কিন্তু বড় চিন্তান্বিত সে। হাঁটুর উপর থুত্রী রাখিয়া অবিচলতার নারী-প্রতীক রূপে বসিয়া রহিল।
ওঠো বুবু। হাসুবৌ হাত ধরিয়া বলিল, ওঠো। তোমার নিজের শরীরও ভালো নয়। কেমন ফোলা-দেখাচ্ছে। এমন করলে শরীর টেকে?
তুমি যাও। আমি উঠছি। দরিয়াবিবি মৃদু কণ্ঠে বলিল।
তুমি ওঠো।
উঠছি। তুমি যাও।
বেশ, আমি উঠানের পৈঠা পর্যন্ত গিয়ে দেখব, না উঠলে আবার আসছি।
হাসুবৌর যা কথা তাই কাজ। কিন্তু দরিয়াবিবি সত্যই তাড়াতাড়ি উঠিয়া হাঁস মুরগির খবরদারীতে মনোযোগ দিল।
.
৪৩.
সাকের নঈমাকে সদরের হাসপাতালে লইয়া গিয়াছিল। চোখের দৃষ্টি তার ক্রমশ নিষ্প্রভ হইয়া আসিতেছে। এত বেশি পিচুটি পড়ে, সকালে সে চোখই খুলিতে পারে না। তাই দরিয়াবিবি সাকেরের শরণাপন্ন হয়। চন্দ্র কোটাল বহুদিন এদিকে মাড়ায় নাই। হাসপাতালের ডাক্তার ঔষধ দিয়াছে। কিন্তু রোগের প্রতিকার অনিশ্চিত। ডাক্তারের অভিমত দরিয়াবিবি শুনিয়াছিল। কিন্তু সে ব্যাপারটা আর গুরুতর মনে করে না। অন্ধের কি দিন বন্ধ থাকে?
গত দুই মাসে দরিয়াবিবি বড় স্থির ও শান্ত হইয়া আসিল। কাজের গাফিলতি হয় না কিন্তু সব কাজ ধীরে ধীরে। মন যেন আর কোথাও উধাও, তারই পটভূমিকায় দৈনন্দিনতার কর্তব্য-সাধন মাত্র। ছেলেদের উপর রাগও নাই। শরী কত বিরক্ত করে, দরিয়াবিবি মোটেই তা গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না। আমজাদ একদিন মার কোপন-স্বভাবের জন্য যেমন ভীত হইয়াছিল, আজ আবার বর্তমান অবস্থার জন্য তেমনই ভয় পাইল। তার ছেঁড়া লুঙি ও শার্ট সেদিন পাওয়া গেল না। নালিশ জানাইলে মা জবাব দিল, গেছে যাক। আর কোনো ধমক নয়। দরিয়াবিবি যেন ধমক দিতে ভুলিয়া গিয়াছে। আমজাদ তাই অস্বাভাবিকতার আবহাওয়া স্বতঃই টের পায়। আমিরন চাচি আসিলে দরিয়াবিবির চাঞ্চল্য সামান্য বাড়ে। হাসুবৌ কোনো পাত্তা পায় না। তাহার সহিত দু-একটি কথা হয় মাত্র। চুপচাপ বসিয়া বসিয়া সে চলিয়া যায়। দরিয়াবিবি কোনোদিন মুখরা ছিল না। কিন্তু এখন তার সমস্ত কথা যেন শেষ হইয়া গিয়াছে।
একদিন সকালেই রাজকীয় উপহারে সজ্জিত ইয়াকুব আসিল। ছেলেদের সম্মুখে দরিয়াবিবি কোনো নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘৃণা করে। সহজেই সে জিনিসপত্র গুছাইয়া রাখিল!
ইয়াকুব তাড়াতাড়ি আমজাদের বিছানায় শুইয়া পড়িল। তার চোখমুখ কোটরাগত ও শীর্ণ। দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসাবাদ কিছুই করে না। কখন এলে? বা এই জাতীয় মামুলী প্রশ্ন মাত্র।
একটু পরে আমজাদের কক্ষে দরিয়াবিবি প্রবেশ করিল।
ঘুমুচ্ছো? ইয়াকুবের নিকট তার প্রথম প্রশ্ন। ইয়াকুব মুখে চাদর ঢাকা দিয়া শুইয়াছিল। দিনের আলোয় মুখ দেখাইতে সে যেন ভয় পায়।
ইয়াকুব মুখের আবরণ খুলিয়া অন্যদিকে দৃষ্টি দরিয়াবিবির তরফে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমাকে কিছু বলছ?
দরিয়াবিবি প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। ইয়াকুবের মুখের উপর পনেরোটি রূপার টাকা ঝনঝন শব্দে রাখিয়া বলিল, মাস-মাস তোমাকে এই টাকা আর দিতে হবে না।
কেন? ইয়াকুবের মুখ বিবর্ণ। জ্বরে তার হাড় সিদ্ধ হইতেছিল, এমনই দেহে কোনো জৌলুশ ছিল না।
দরিয়াবিবি কক্ষ-ত্যাগের জন্য পা বাড়াইলে প্রায় আসন্ন-মৃত্যু রোগীর চেরা-কণ্ঠে ইয়াকুব ডাকিল, শোনো।
দরিয়াবিবি গমন-পথের দিকে চাহিয়া পেছন ফিরিয়া বলিল, বল।
আমার বড় জ্বর, আজ এক সপ্তাহ। আমি তোমাদের এখানে একটু শান্তি পেতে এসেছি।
আমরা কি তোমার কাপড়ে আগুন লাগাচ্ছি? বড় নির্মমের মতো দরিয়াবিবি জবাব দিল।
তা কেন? এমন দুঃখের দিনে তোমরা আমাকে জায়গা দিয়েছ, তা কি কম উপকার? আমার ঘরে শান্তি নেই, দেহ ভালো নয়। এই টাকাগুলো নিয়ে গেলে আমার মনে কোনো কষ্ট থাকবে না।
ও টাকাগুলোর আর দরকার নেই।
নেই?
না। দরিয়াবিবি তখনই আবার জিজ্ঞাসা করিল, তুমি সাগু খাবে?
হ্যাঁ। কাতর কণ্ঠের আর্তনাদের মতো শোনায় ইয়াকুবের জবাব।
দরিয়াবিবি রোগীর অন্য প্রয়োজন জানার অপেক্ষায় রহিল না। দ্রুতপদে বাহির হইয়া গেল।
আমজাদ আজ মার উৎসাহ দেখিয়া অবাক। মাছ ছিল কয়েক রকমের। ইয়াকুব সের দুই খাসির গোস্ত ও অন্যান্য শাক-সজিসহ ঘি আনিয়াছিল। দরিয়াবিবি পরম আগ্রহে রন্ধন-বিদ্যা উজাড়ে মনোযোগ দিল। শত্রু কোথাও যেন ধরাশায়ী। তাই যেন বিজয়ী বীরের উল্লাস। খাওয়ার সময় উৎসাহে আদৌ ভাটা পড়িল না। মার এমন আগ্রহান্বিত আহার আমজাদ জীবনে দেখে নাই। রান্না হইয়াছিল চমৎকার।
ভূরিভোজনের বিশ্রামের পর সাগু হাতে ঢুকিয়া দরিয়াবিবি দেখিল, ইয়াকুব ঘুমাইতেছে। ভাঙা তক্তপোষের একদিকে বাটি বসাইয়া সে চাহিয়া দেখিল। তার মুখের এমন পূর্ণ আদল সে আগে দেখে নাই। মলিন লতার মতো সারা চেহারায় বিশীর্ণতা। কত দুঃখ-ভারাক্রান্ত এই শায়িত ব্যক্তি, তা তার চোখের কালি-মাখা কোণগুলিতে স্পষ্ট।
দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া দরিয়াবিবি ঐ মুখ পুঙ্খানুপুঙ্খ অবলোকন করিল। বেচারা বড় দুঃখী! ঘরে সাতদিন জ্বরে ভুগিয়াছে, আজও জ্বর-জ্বর-দেহে গৃহত্যাগী। খুব জ্বর, হয়ত এই শেষ শয্যা। আজহারের শেষ কয়টি দিন দরিয়াবিবির চোখে নিমেষে খেলিয়া গেল।
নিঃশব্দে ইয়াকুব ঘুমাইতেছিল অথবা চোখ বুজিয়া ছিল কে জানে। দরিয়াবিবির কেমন মায়া হয়। হঠাৎ তার বুকে করুণা উথলিয়া উঠে। নৌকায় সারা পথ আসিয়াছে, এক মাইল হাঁটিয়াছে, এখনো অভুক্ত। এখনো অভুক্ত! দরিয়াবিবি আর স্থির থাকিতে পারে! তার ইচ্ছা হইল : একবার ঘুম ভাঙাই সাগুটুকু খেয়ে নিক। কিন্তু ডাকিতে গিয়া, খামিয়া গেল। কে যেন গলা টিপিয়া ধরিল অকস্মাৎ!