হয়ত অনন্তকাল এমনভাবে দাঁড়াইয়া থাকিলে দরিয়াবিবি আনন্দিত হইত, কিন্তু হঠাৎ মানুষের ছায়া পড়িল জোছনায়। শিহরিয়া, তাড়াতাড়ি উঠানের দিকে যাইবে, সে দেখিল ইয়াকুব তাহার দিকে অগ্রসর হইতেছে। সম্মোহিতের মতো দরিয়াবিবি নিজের জায়গায় স্থাণু।
কয়েক মুহূর্ত পরে সম্বিৎ ফিরিয়া আসিলে দরিয়াবিবি ফিসফিস কণ্ঠে বলিল, এখানে কেন?
কেন, তুমি জানো না, দরিয়া? ইয়াকুব তার হাত ধরিয়াছে ততক্ষণে।
হয়ত হাত টানাটানি শুরু হইত, জানালা হইতে মুখ বাড়াইয়া মোনাদির ডাকিল, মা, এত রাতে তুমি একা বাহিরে গেছ, আমাকে ডাকলে না কেন?
আসছি বাপ। তুমি ঘুমোচ্ছিলে, তাই আর জাগাইনি।
ইয়াকুব চোরের মতো আড়াল অন্ধকারে লীন হইতে গেল, কিন্তু তার লম্বা ছায়া জোছনার হাত এড়াইতে পারিল না।
দরিয়াবিবি কম্পিত বুকে তাড়াতাড়ি আসিয়া দরজা বন্ধ করিল। মোনাদির তখনো জানালায় দাঁড়াইয়া। মাকে, বলিল, মা চোরটোর হবে। একটা লোকের ছায়া পড়ল কাঁঠাল গাছের পাশে।
না। অন্ধকারে দরিয়াবিবি আবার বলিল, তুমি এসো, শুয়ে পড়।
যাই। মা, তুমি একলা এমন রাত্রে বেরিয়ো না।
কি আছে আমাদের, চোর আসবে?
মোনাদির কয়েক মিনিট জ্যোৎস্নার দিকে চাহিয়া নিজের বিছানায় ফিরিয়া আসিল।
সারাদিনের ক্লান্তি, উদ্বেগজনিত নিদ্রাহীনতা–ভোরের দিকে দরিয়াবিবির চোখে ভয়ানক ঘুম নামিয়াছিল। কাক ডাকা সকাল তার জীবনে প্রথম দেখে নাই।
আরো কতক্ষন ঘুমাইত কে জানে, হঠাৎ আমজাদ আসিয়া ডাক দিল, মা, মা।
খোঁয়ারি চোখে দরিয়াবিবি ধমক দিল, কি, এত ডাকছিস কেন?
মুনি ভাইয়ের কাপড়চোপড় কোথা?
বাঁশের আলনায় আছে।
কই নেই তো?
দরিয়াবিবি চোখ খুলিয়া চাহিল।
তোর ঘরে নেই?
না। ইয়াকুব চাচা সকালেই চলে গেছে।
দরিয়াবিবি কাঁথা জড়াইয়া উঠিয়া পড়িল। বারবার চোখ কচলাইল। মোনাদিরের ঝোলা, কাপড়চোপড় আলনায় নাই।
বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল দরিয়াবিবি। তার শরীর থরথর কাঁপিতেছে।
দিঘীর পাড়ে গিয়ে দেখ তুই, সেদিকে গেছে বোধহয়।
আমজাদ চলিয়া গেলে দরিয়াবিবি পাশের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল, মোনাদিরের বইপত্র নাই।
দরিয়াবিবি হয়ত মূৰ্ছিত হইয়া পড়িয়া যাইত। কিন্তু মনে মনে বুকে জোর সঞ্চয় করে সে। না, মূৰ্ছা যাওয়া তার সাজে না।
তাল সামাল দেওয়ার জন্য ঝিম ধরা মাথা দুই হাতে শক্ত করিয়া ধরিয়া দাওয়ার উপর দরিয়াবিবি বসিয়া পড়িল। একটু হাঁফ ফেলা দরকার শুধু।
.
৪২.
চন্দ্রমণি এক রাত্রে রাজেন্দ্রের সঙ্গে গ্রাম ত্যাগ করিয়াছিল। চন্দ্র কোটাল প্রায় একমাস আর গ্রামের ভিতর আসে নাই। আমজাদ নিজেই যাইত খোঁজ-খবর লইতে। চন্দ্র যেন আর এক রকম হইয়া গিয়াছে। তাড়ি সে খায়। কিন্তু নিঃশব্দে খায়। আর হল্লা করে না, গান করে না। চন্দ্রমণির ছেলে দুটি মামার কাছেই আছে।
দরিয়াবিবি এই সংবাদ শুনিয়াছিল হাসুবৌর মুখে, আমিরন চাচির মুখে। কিন্তু কোনো মন্তব্য করে নাই। বিপদে-আপদে কোটালের কাছে আমজাদকে পাঠানো বৃথা। যে যার মাথার ঘায়েই পাগল। এইজন্য দরিয়াবিবি কোটালের জন্য বড় দুঃখিত। আহা, এমন মানুষের কপাল বটে! কিন্তু উপায় কোথায়? দাদার গলগ্রহ জীবনের চেয়ে চন্দ্রমণি তার কারো আশ্রয়ে গিয়াছে। সংসারের কতটুকু ক্ষতি তাতে? হয়ত দরিয়াবিবির মনে এইসব কথা উঁকি দিয়াছিল।
দরিয়াবিবির একদিন সন্ধ্যায় কোটালের বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। আমজাদ খুব রাজি না। কিন্তু আর যেন সেদিকে পা বাড়ানোর উৎসাহ নাই। খ্যাপা কোটালের সংসার দেখার ইচ্ছা কার না হয়? আজহারের মতো ধর্মান্ধ ধর্মভীরু লোকটি চন্দ্রকে চিনিয়াছিল। কিন্তু সে জীবিত থাকিতে দরিয়াবিবি এমন প্রস্তাব উত্থাপন করে নাই। আর যাওয়া হোলো না, দরিয়াবিবি সেদিন মনে মনেই উচ্চারণ করিল। গ্রাম্য জীবনে একজনের অপবাদ সমস্ত বাড়ির উপর ভর করিয়া থাকে।
এক মাস পরে আমজাদ মার কাছে আসিয়া জানাইল, মা, আজ মুনি ভাইয়ের টাকা ফেরত এল। এই নাও টাকা। আমজাদ পনেরোটি টাকা গণিয়া দিল।
টাকা ফেরত এল কেন?
পিয়ন বললে মুনিভাই সেখান থেকে চলে গেছে।
অস্ফুট কণ্ঠে দরিয়াবিবি একবার উচ্চারণ করিল, চলে গেছে! তারপর পুত্রের সহিত আর কোনো বাক্যালাপ করিল না। অবিচল মূর্তির মতো টাকা কয়টি হাতে দরিয়াবিবি বসিয়া রহিল। দুশ্চারিণী জননীর দান সৎ সন্তান কেন গ্রহণ করিবে? মুনি–
আমজাদ হাসুবৌকে তখনই খবর দিয়া আসিয়াছিল। পিয়ন তাহাদের বাড়ির পাশেই দাঁড়ায়। হাসুবৌ আসিল। দরিয়াবিবির অশ্রুসজল মুখের দিকে চাহিয়া সে আর কোনো কথা বলিল না, নিঃশব্দে পাশে বসিয়া পড়িল।
দরিয়াবিবির মুখাবয়ব ক্রমশ থমথমে, গৌরসুডোল গণ্ডদেশ বহিয়া অশ্রু গড়াইতে লাগিল। হাসুবৌ আমজাদকে বলিল, বাবা, একটু পানি এনে দে।
আমজাদ বিলম্ব করিল না আদেশ-পালনে।
হাসুবৌ দরিয়াবিবির চোখের পানি মুছাইতে মুছাইতে বলিল, বুবু একটু বারফাট্টা ছেলে। আবার আসবে। বেটাছেলের জন্য এত চিন্তা কেন?
দরিয়াবিবি কোনো জবাব দিল না। হাসুবৌ আবহাওয়া সহজ করিতে ছুঁতানাতা খোঁজে। বলিল, বুবু, সন্ধ্যা হয়, এখন কত কাজ তোমার, উঠে পড়।
উঠানে একপাল মুরগি-হাঁস কোলাহল তুলিয়াছিল। ইহাদের সান্ধ্য-ভোজন বাকি। হাসুবৌ আরো জিদ ধরিল, বুবু, তুমি না উঠলে আমি বাড়ি যেতে পারব না। তোমার ছেলে তোমারই আছে।