দরিয়াবিবি উত্রাইয়ের মুখে আসিয়া পৌঁছিয়াছিল। চারদিকে শ্বাপদসংকুল খাদ ভরা অরণ্যানী। পানি আর তৃষ্ণা মেটায় না, বাতাস আর শ্রান্তি হরণ করে না।
মা।
দরিয়াবিবি চাউলের কাঁকর বাছিতেছিল। উঠানের দিকে পিঠ। সুতরাং আগন্তুকের সংবাদ সে জানিতে পারে নাই। চকিতে চোখ ফিরাইয়া দরিয়াবিবি অবাক হইয়া গেল। মোনাদির আসিয়াছে। পিঠের উপর একটি বোঝা-সমস্ত শরীর ঘামে ভিজিয়া গিয়াছে। পথ-চলার ক্লান্তি পথিকের নিঃশ্বাসের দ্রুততায় ধরা পড়ে।
হঠাৎ এলি নাকি, বাবা?
গরমের ছুটি হতে এখনো তিন মাস বাকি। স্কুলে পরীক্ষা হচ্ছে, এক হপ্তা ছুটি। তাই চলে এলাম।
বেশ করেছ।
দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি নিজের হাতে মোনাদিরের জামা খুলিয়া ঘাম মুছিয়া দিল। হাঁকডাকে আমজাদ আসিয়া হাজির। সে একটা মোড়া আগাইয়া দিল।
দরিয়াবিবি বড় খুশি। তাড়াতাড়ি ভাত চাপাইয়া দিল। দুপুরের হাঁড়ি শূন্য। কিছুক্ষণ আগে তাহারা আহার সমাধান করিয়াছে। আমজাদ মাঝে মাঝে হাত-খরচের লোভে মুরগি-হাঁসের ডিম লুকাইয়া রাখে। সে একটি ডিম আনিয়া দিল।
দরিয়াবিবি জিজ্ঞাসা করিল, আণ্ডা কোথা পেলি?
আমাদের লাল মুরগিটা যেখানে-সেখানে ডিম পাড়ে। কাল গোয়ালঘরের মাচাঙে। ছিল। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।
পুত্রের আবিষ্কার-দক্ষতায় দরিয়াবিবি খুব উৎফুল্ল হয়। সে আলুভাজা আর ডাল করিতে চাহিয়াছিল। এখন ডিম পাওয়া গেল। আহারের মোলোকলা পূর্ণ।
মোনাদির পুকুরে গোসল করিয়া আসিল। অজানা পরিতৃপ্তি তার মনে। তাই ভাই বোনদের সঙ্গে নানা গল্প ছাড়িল। ঝোলা হইতে কয়েকটি মাটির পুতুল সে নঈমা ও শরীকে দিল। তাহাদের খুশির অন্ত নাই। একজোড়া ভালো লাটিম বাহির করিল মোনাদির আমজাদের জন্য। দুই ভাইয়ে কাল নদীর ধারে গাছতলায় খেলব, এই প্রস্তাবে আমজাদ লাফাইয়া উঠিল।
দরিয়াবিবির কাছে সমস্ত বৈকাল যেন সুরের মতো বাজিতে থাকে। ছেলেপুলেদের লইয়া সে বহুদিন এমন আনন্দ পায় নাই। অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে সে রাত্রির রান্নায় বসিল। আমিরন চাচির গাছ হইতে একটি লাউ চাহিতে গিয়াছিল আমজাদ। সে লাউয়ের সঙ্গে একটা মুরগিছানা দিয়াছে। কদু-গোস্তের তরকারী বাধিতে দরিয়াবিবি সমস্ত নৈপুণ্য ঢালিয়া দিল।
আহার শেষে দাওয়ায় অনেকক্ষণ গল্প-গুজব শুরু হইল। মোনাদিরের কাছে পরিবেশ আর অচেনা নয়। সে বেশ সহজ। দরিয়াবিবিও প্রাণ খুলিয়া ছেলেদের হল্লায় যোগ দিল।
পরদিন আমজাদ ও মোনাদির টো টো করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইল। চন্দ্র কোটালের ভিটায়, নদীর ধারে, মাঠে মাঠে, সড়কের আশপাশে ঝোপে-জঙ্গলে দুইজনের গতিবিধি। আমজাদ তো এমন স্বাধীনতাই প্রতিদিন কামনা করে। একা একা সে আবার বড় ভীরু ও লাজুক। শুধু মুনি ভাই সঙ্গে থাকিলেই সে সব কাটাইয়া উঠিতে পারে।
মার মেজাজ বড় হালকা আজকাল। আমজাদ তাই আরো খুশি।
মোনাদিরই প্রথম অনুজকে জিজ্ঞাসা করিল, আমু, মা বড় মোটা হয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ। মুনি ভাই, আমার মনে হয় অসুখ!
না। মার শরীর আমার মতো কিনা।
তা ঠিক মুনি ভাই। বড় হলে তুমি চন্দ্র কাকার মতো জওয়ান হবে।
তাই তো বেঁচে আছি। স্কুলের বোর্ডিংয়ে যা খাওয়ায়, এতদিন আমারও অসুখ করত।
ভ্রাতৃবিক্রমে আমজাদ গৌরবান্বিত। সে প্রস্তাব করিল, তুমি সাকের চাচার কাছে লাঠি খেলা শিখবে?
গ্রামে এসে থাকলে নিশ্চয় শিখব। আমি খুব ভালো লাঠিখেলা শিখতে পারব। মোনাদির হাতের পেশী দেখাইল।
নদীর ধারে এক জায়গায় দাঁড়াইয়া দুইজনের কথাবার্তা চলিতেছিল। চৈত্র মাস। তাই নদী শুষ্ক। দুই পাশে চলে খাগড়া বন। মাছরাঙার বাসা খুঁজিয়া অনেকক্ষণ দুইজনে কাটাইয়াছে। কোনো লাভ হয় নাই। একটি বড় চালতা গাছের গুঁড়ির উপর দুইজনে ঠেস দিয়া দূরে দূরে চাহিতেছিল। আকাশ একদম মেঘহীন। রৌদ্রের তরল ঝরণায় সমস্ত মাঠ ঝমঝম বাজিতেছে। নিঃসঙ্গ তালগাছ বাতাসের দীর্ঘশ্বাসে প্রত্যঙ্গের থরথরানি মিশাইয়া দিয়াছে। গ্রাম্য দুই বালক কথার ফাঁকে ফাঁকে পৃথিবীর বিশালতা অনুভব করে।
শুধু ক্ষুধার তাড়না এই অবসর উপভোগে ছেদ টানিল। মোনাদির বাড়ি ফিরিয়া দেখিল ইয়াকুব আসিয়াছে। মা বলে নাই, তবে আমজাদ বলিয়াছে, এই লোকটি গত তিন-চার বৎসর তাহাদের বহু উপকার করিয়াছে। মোনাদির অচেনা লোকের সম্মুখে বড় লাজুক। শুধু সে আর নিজে কোনো আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করিতে পারে না।
রাত্রে ছেলেরা আহারে বসিল। দরিয়াবিবি মিয়মাণ দাসীর মতো কর্তব্য সম্পাদন করিতে লাগিল। আমজাদ আসর জমাইতে চায়। কি একটা মুনি-সম্পর্কিত রসিকতা করিতে গিয়া সে ধমক খাইল। তখন আহারই একমাত্র তপস্যা হইয়া দাঁড়াইল সকলের পক্ষে।
দুইটি মাত্র কক্ষ। আমজাদ ও ইয়াকুব এক কামরায়, অন্য কামরায় মার কাছে নঈমা ও শরীর সহিত মোনাদিরের শয়ন ব্যবস্থা হইল।
আজ মার সঙ্গে বিশেষ কোনো কথা হইল না। সারাদিন কত খাটে, এই ভাবিয়া মোনাদির ঘুমাইয়া পড়িল।
দরিয়াবিবি বিনিদ্র বহুক্ষণ পড়িয়া রহিল। গরমের দিন। তবু একটি কথায় তার হাঁটু পর্যন্ত চাপা। গরম, তার উপর দৈনন্দিন চিন্তার টানাপোড়েন। বাহিরে জানালা দিয়া দেখা যায় আকাশ ভরিয়া কত জ্যোৎস্না উঠিয়াছে।
ঘুম আসিতেছিল না। দরিয়াবিবি সকলকে ঘুমন্ত দেখিয়া ধীরে ধীরে উঁটি খুলিয়া উঠানে দাঁড়াইল। জানালার কাছে কাঁঠাল গাছের পাতার ফাঁকে জোছনা পড়িয়াছে মাটির উপর। দরিয়াবিবি আনমনা গিয়া দাঁড়াইল। আকাশে নিষ্প্রভ কয়েকটি তারা জ্বলিতেছে মাত্র। সমস্ত আকাশ তো গাছের তলা হইতে দেখা যায় না। দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়া রহিল বেশ কিছুক্ষণ। সুপ্ত গ্রামের নীরবতা কৃচিৎ পাখির ডাকে, দূরাগত কুকুরের চিৎকারে চিড় খায় মাত্র।