আমজাদ এক বদনা পানি পিতার সম্মুখে রাখিয়া বলে : পানি তেতে উঠেছে, কাল থেকে সকালে বা এনে রেখো।
আজহার খাঁ এক লুকমা ভাত গালে তুলিয়াছে, চোয়াল নাড়িতে নাড়িতে জবাব দিল : হোক, ক্ষতি নেই বাপ। আজ ভুক লেগেছে জোর।
এক আঁটি খড়ের উপর বসিয়া আমজাদ বাবার আহার-পদ্ধতি নিরীক্ষণ করে। তরকারি ভালো নয় আজ। সামান্য ডাল আর চুনোমাছের শুরুয়া।
আমজাদ মাঠের চারিদিকে তাকায়। ধু ধু করিতেছে দূরের মাঠগুলি। নদীর দুই পাশে সবুজ রবি-ফসলের ক্ষেত। সেখানেও রঙ বিবর্ণ। চৈত্রের বাতাস ঝামাল তোলে। বালু ধূলিকণা অন্য গাঁয়ের দিকে উড়িয়া যায়। পাতলা একখণ্ড রঙিন ধোঁয়া যেন পাড়ি জমাইতেছে গ্রামান্তরে।
এই বছর আজহারের লাউ ছাড়া অন্য রবি-ফসল নাই। কুমড়ার লম্বা ডগা সাপের মতো জড়াজড়ি করিয়া রৌদ্রে ঝিমাইতেছে। মাটির ঢেলার উপর একটি কুমড়া দেখা যায়। সবেমাত্র পাক ধরিয়াছে। হলুদ-ধূসর একরকমের রং চোখ-ঝলসানো আলোয় আরো স্পষ্ট হইয়া উঠে। আমজাদের চোখ বারবার সেই দিকে আকৃষ্ট হয়।
আব্বা!
আজহার খাঁ মুখ তোলে। রৌদ্রে মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গিয়াছে। তার উপর কালো একগোছা দাড়ি! কয়েকটা ভাত লাগিয়া রহিয়াছে ঠোঁটের এক কোণে। সেদিকে চাহিয়া আমজাদের হাসি আসে।
ঐ কুমড়াটা পেকেছে।
খুব পাকেনি।
তুমি সেবার বললে, ঘরে তুলে রাখলে পেকে যায়।
আজহার খাঁ মুখে একগাল ভাত তুলিল। একটু থামিয়া সে বলে, পাকবে না কেন?
পুত্রের জিজ্ঞাসার হেতু আজহার খাঁ উপলব্ধি করে।
কুমড়াটা ঘরে নিয়ে যেতে চাও?
হ্যাঁ। খুব লজ্জিত হয় আমজাদ, যেন সে কত অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছে।
না, এখন থাক, বাবা। সামনে হপ্তায় একশ কুমড়া গঞ্জে দেওয়ার কথা আছে। কিছু বায়না নিয়েছি।
পুত্রের মুখের দিকে চায় এবার আজহার খাঁ। কচি শিশুর মুখের উজ্জ্বলতা নিভিয়া গিয়াছে।
আরো কয়েক মুঠি ভাত থালায় পড়িয়া রহিল। আজহার খাঁ বিষণ্ণ হইয়া যায়। একশ কুমড়া এই সপ্তাহে জমি হইতে উঠিবে কিনা সন্দেহ, হয়ত অন্য চাষীর নিকট হইতে কেনা ছাড়া উপায় থাকিবে না। ছেলেদের সামান্য আবদার রক্ষা করাও তার ক্ষমতার বাহিরে। পাইকের আসিয়াছিল গত সপ্তাহে। অগ্রিম বায়না লইয়াছে সে। ওয়াদা-খেলাফ খা পছন্দ করে না। নচেৎ খুব ক্ষতি হইবে তার। অন্য সময় মাঠে কুমড়া পচিতে থাকিবে, পাইকের চুঁইয়া দেখিবে না পর্যন্ত।
আজহার ছেলের মুখের দিকে তাকাইতে সাহস করে না। মুখ নিচু করিয়া বলে, ওদিকের মাঠে তরমুজ হয়েছে খুব। তরমুজ খাবে?
হাসিমুখে আমজাদ পিতার মুখের দিকে চায়। তরমুজের নামে তার ঠোঁটে-মুখে আনন্দ রেখায়িত হয়।
আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি নদী থেকে। বসো, বাবাজি।
নদীর পাড়ের নিচে আজহার ক্রমশ অদৃশ্য হইয়া গেল। পিতার বলীয়ান ছায়া মূর্তির দিকে আমজাদ চাহিয়াছিল, সেইদিকেই দৃষ্টি মেলিয়া দিল। মাঠে বাতাস আছে, তাই দারুণ গ্রীষ্মে কোনোরকমে সহ্য করা যায়। গাভীদল নির্বিবাদে মাঠে চরিতেছে। দূরে একটি কুঁড়ের পাশে পাকুড় গাছের তলায় কতগুলি ছেলে খেলা করিতেছিল। তাহাদের হল্লা আমজাদের কানে গেল। আবার চোখ ফেরায় সে। একটু পরে সে শুনিতে পাইল, কে যেন শিস দিতেছে। কোনো পাখির ডাক বোধহয়। আমজাদের চেনা পাখি নয়। অদ্ভুত ধরনের শিস। আমজাদ এদিক-ওদিক ইতস্তত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।
হঠাৎ শিস থামিয়া গেল।
কাদের ছেলে রে?
চমকিয়া ওঠে আমজাদ। কলাগাছের আড়াল হইতে হঠাৎ একটা লোক বাহির হইয়াছে। যাক্, ভয়ের কিছু নাই। লোকটির মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কালো কুচকুচে গা। হাতে একটি কাস্তে ও নিড়েন-দেওয়া দাউলী।
আবার শিসের জোয়ার ছোটে। এই লোকটি শিস দিতেছিল তা-হলে! ডাগর চোখ তার ঘন-কালো। লম্বা-চওড়া জোয়ান। ভয় করে আমজাদের।
তার দিকে চাহিয়া সে বলে, কাদের ছেলে? তরমুজ চুরি করতে বেরিয়েছ, না?
ভয়ে জড়সড় হইয়া যায় আমজাদ। আজহার কাছে নাই। নদীতে বৃথা বিলম্ব করিতেছে সে।
চুরি করতে বেরিয়েছ?
না। আমি ভাত এনেছি।
লোকটা অকারণ হাসিয়া উঠিল, আবার শিস দিতে দিতে সে গান গায় :
সর্ষে ক্ষেতের আড়াল হল চাঁদ,
চোখে তার মানুষ-ধরা ফাঁদ
ও উদাসিনী লো–
মাথার বাবুরি চুল গায়কের বাতাসে উড়িতেছিল। গান থামিল কয়েক কলি দোহারের পর।
ভাত এনেছ?
আমজাদ ম্রিয়মাণ বালকের মতো উত্তর দিল : আব্বা সব খেয়ে ফেলেছে।
তাহলে আমার জন্যে রাখোনি কিছু। বাহ্।
মুখ সামান্য নিচু করিয়া আমজাদের দিকে সে দুষ্টুমির হাসি হাসে আর তাকায়। ঠোঁট বাঁকাইয়া সে চোঁ চোঁ শব্দ করে।
একটুও ভাত রাখলে না বাপ-ব্যাটা মিলে! হি-হি।
সর্ষেক্ষেতের আড়াল হল চাঁদ,
চোখে তার মানুষধরা ফাঁদ
ও উদাসিনী লো —
আমজাদের ভ্যাবাচ্যাকা লাগে। হয়তো লোকটা পাগল। এইবার সে কোমরের উপর বাম হাত রাখিয়া একটু বক্রভাবে দাঁড়াইল। তারপর ঠোঁটের একপাশে অন্য হাত চাপিয়া লোকটা জোরে চিৎকার করিয়া উঠিল : এই, তরমুজ ক্ষেতে কে?
আমজাদ নদীর আশেপাশে জমির দিকে তাকায়। সেই ছেলেগুলি খেলা করিতেছে। মাঠে জনপ্রাণীর আভাস নাই। গরুগুলি জাবর কাটিতে ছায়ার আশ্রয় সন্ধান করিতেছে।
তবু লোকটা চিৎকার করে। অদৃশ্য উদাসিনীর উদ্দেশ্যে বোধহয়। একটা চুমকুড়ি দিয়া সে ছায়ায় বসিয়া পড়িল। একদম আমজাদের পাশে। তাড়ির গন্ধ উঠিতেছে মুখে। আমজাদ একটু সরিয়া বসে।