দরিয়াবিবি বলিল, অবেলাটা বড় সুখে কাটল আমিরন বোন।
আবার এসো মুনি চাচা। তুমি পরশু দিন সকালে যাবে, তখন আমি থাকব এই হতভাগীকে সঙ্গে নিয়ে। চাচি সহাস্যে মেয়ের দিকে আঙুল বাড়াইল।
হাসুবৌ শুধু বড় ম্রিয়মাণ। তার আবার শাশুড়ির ভয় জাগিয়াছে।
আজ আমিরন চাচি সকলের সঙ্গে সড়কের অনেক দূর পর্যন্ত আগাইয়া আসিল কথা বলিতে বলিতে। কথা আর ফুরায় না।
.
৪০.
চন্দ্র কোটালের প্রস্তাব মোনাদিরের খুব ভালো লাগিয়াছিল। মুনি চাচা লেখাপড়া জানে, আমাদের গানের দলের অধিকারী হবে, আর সমস্ত গান লিখে রাখবে। আজকাল গেঁয়ো, সোজা গান বাবুরা পছন্দ করে না। চাচা ভাষা ঠিক করে দেবে?
কিন্তু যথাসময়ে মোনাদির চলিয়া গেল। এই বাড়িতে কেন যেন মন টেকে না। মাঝে মাঝে মায়ের হৃদয়ের উত্তাপহীনতা সে উপলব্ধি করিতে শিখিয়াছিল। এই তিনদিনেই সে বুঝিয়াছিল, মা আগের মতো তার জন্য আকুলি-বিকুলি করে না। দরিয়াবিবির আকস্মিক ব্যবহারে আমজাদ দুঃখ পাইত, মোনাদির বিস্মিত হইয়াছিল। কিন্তু কিশোরের মনে তার কোনো বিশেষ দাগ পড়িল না। যাওয়ার দিন দরিয়াবিবি বারবার অনুরোধ করিল, সে যেন ছুটি পাইলেই চলিয়া আসে।
হাসুবৌ ইদানীং এই বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত করে। কাছে সহানুভূতিশীল আর কোনো প্রতিবেশী নাই। বন্ধ্যা জীবনে জুলুম সহ্য করিতে হয়। এইখানে তবু মনের ভার হালকা করা যায়। দরিয়াবিবি এই নিরীহ সরল বধূটির প্রতি বড় স্নেহশীল। সাকেরের মা তাই লইয়া মনে মনে গজ গজ করিত, অবশ্য মুখে কিছু বলিত না। কারণ সাকের দরিয়াবিবির কথা সহজে অবেহলা করে না। দরিয়াবিবির খাতিরে সে তার মার সঙ্গে বিবাদ জুড়িতেও প্রস্তুত।
মোনাদির চলিয়া যাওয়ার দিন খুব সকাল সকাল হাসুবৌ এখানে আসিয়াছিল। অনেক বেলা হইয়া গেল, তবু বাড়ি যাওয়ার নাম নাই। দরিয়াবিবির সহিত এ কথা সে কথা ও গৃহস্থালীর ছোটখাটো কাজ করিয়া দিল।
বুবু, মন খারাপ কর না, এমন সোনার চাঁদ ছেলে। ও তোমার ছাড়া কার? এমন বহু সান্তুনা-বাক্য হাসুবৌর মুখে আজ যেন লাগিয়াই ছিল।
দরিয়াবিবি বড় বিষণ্ণ। কাজকর্ম করিতেছিল, কিন্তু সহজ কথোপকথনে তার মন। ছিল না।
বাঁশের একটি চুপড়ি ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। হাসুবৌর সহযোগিতায় দরিয়াবিবি তা মেরামত করিতে বসিল।
বুবু, আল্লার মরজি, তোমার শরীর বেশ আছে। তুমি বেশ মোটা হচ্ছ।
দরিয়াবিবি কোথায় কাপড় অসম্বৃত এই আশঙ্কায় নিজের দিকে চাহিয়া লইয়া জবাব দিল, লোকে বলে, আছে ভালো, কিন্তু ওদিকে শালুক খেয়ে যে দাঁত কালো তার খবর কেউ রাখে না।
হাসুবৌ চুপ করিয়া গেল। দরিয়াবিবির কণ্ঠে সৌহার্দ্যের লেশ ছিল না। যেন ঝগড়ার মুখে আর একজনের সঙ্গে সে কথা কাটাকাটি করিতেছে।
শাশুড়ির চিৎকার শোনা গেল। হাসুবৌ হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিল। দরিয়াবিবির যেন তার উপর কত খাপ্পা। হাসুবৌ তাই ভয় পাইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, এখন যাই, বুবু।
দরিয়াবিবি নিজের মনে একটি কঞ্চি ফাড়িতে লাগিল। কোনো জবাব দিল না হয়ত শুনিতে পায় নাই। সে নিজের কাজে মগ্ন। হাসুবৌ অপরাধীর মতো বিদায় লইল।
সেদিন বিকালে ইয়াকুব আসিল। সঙ্গে পুত্র। তাহাকে দরিয়াবিবির কাছে রাখিয়া চলিয়া গেল। আবার দুদিন পরে আসিবে সে।
সমগ্র পরিবারের রসদ দিয়া গিয়াছে, দরিয়াবিবির কোনো অসুবিধা ছিল না। নিজের ছেলে আজই প্রবাসী, আবার পরের সন্তান ঘাড়ে। কিন্তু দরিয়াবিবি কোনো অবহেলা দেখাইল না। ছেলেটার নাম ওয়ায়েস। বেশ ফুটফুটে কথা বলে। আর বড় সুন্দর জবাব দিতে পারে। দরিয়াবিবি মানসিক ভার কাটাইবার উদ্দেশ্যে ছেলেটিকে ইয়াকুবের অন্দর মহলের অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিল।
তোমার দুই মা, না?
হ্যাঁ, চাচি। ছোটমা আর বড়মা। আমি বড় মায়ের ছেলে। আমরা দুভাই।
তোমার ছোটমা কেমন?
খুব ঝগড়া করে মায়ের সঙ্গে বাপের সঙ্গে।
তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে?
হ্যাঁ। আজ ঝগড়া হয়েছে। তাই আমাকে বাপ নিয়ে এল।
ঝগড়া হল?
রোজ ঝগড়া হয়। আজকাল বাপ ঘরে থাকে না।
কোথায় থাকে?
দহলিজে ঘুমায়। আর বাপের অসুখ আছে। শরীর খারাপ।
দরিয়াবিবি চুপ করিয়া যায়। ছেলেটিকে নিজের পাশে শোয়াইয়া আরো তথ্য সংগ্রহ করিল। ইয়াকুবের অন্দর মহল একটি দোজখ। মোটামুটি গ্রাম্য জীবনের সচ্ছলতা আছে, তাই বাড়ির মেয়েরা রান্না-খাওয়া ছাড়া বেকার। টাকার গরম, শাড়ির গরম দেখাইতে পরস্পরে হিংসা, ঝগড়া। এইটুকু ছেলেও কেমন কূটচক্রের ইতিহাস জানে।
দুদিন পর ইয়াকুব ছেলেটিকে লইয়া যাইবার সময় বলিল, দরিয়াভাবী (আর ভাবী সাহেব বলে না) ছেলেটাকে এনে রেখে দেব। ওখানে থাকলে আর মানুষ হবে না।
কথার জবাব দিতে হয়, আমজাদ সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। দরিয়াবিবি বলিল, তোমার পাকা বাড়ি, এখানে বাঁশের ঘরে কেন?
সেখানে ছেলেগুলা মার জন্য খারাপ হবে। খালি কিচামিচি ঝগড়া-ঝাটি।
দরিয়াবিবি আর কোনো জবাব দিল না।
ইয়াকুব পুত্রকে লইয়া পথাভিমুখী হইল। আমজাদের সঙ্গে ওয়ায়েসের খুব খাতির জমিয়াছে। সেও পিছন পিছন গেল।
একটু পরে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, মা, তোমাকে পনেরো টাকা দিয়েছে। ভুলে গিয়েছিল। ওয়ায়েসের বাপ বললে।
মুনি মাত্র দুটাকা সঙ্গে নিয়ে গেছে। কালই টাকা পাঠিয়ে দিতে হয়। মনে মন দরিয়াবিবি সাত-পাঁচ ভাবিতে লাগিল।
৪১-৪৫. অচল দিন
অচল দিনকে প্রাণপণে ঠেলিতে হয়। সমস্ত উদগ্র শিরা-উপশিরা বিদ্রোহী, তবু বিশ্রাম কি শৈথিল্য দেওয়া চলে না। উত্রাইয়ের বাঁকে বোঝাও অনড় হইয়া সংগ্রামশীল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে ব্যঙ্গ করে। উপত্যকায় তখন আবার ঝড় দেখা দিলে, অসহায়তা নৈরাশ্য মেঘ গর্জনের সঙ্গে বিকট প্রতিধ্বনি ধাক্কার বেগে ছুটিয়া আসে।