সকালে সে আবার বকুনি খাইল। বাড়ির পাঁদারে সকালে উঠিয়া আমজাদ দেখে, রান্না তরকারী নয়, শুধু-কাঁচা শাক-সজি পর্যন্ত পড়িয়া রহিয়াছে। কাল ইয়াকুব চাচা এইসব আনিয়াছিল, সে জানে। তাই তাড়াতাড়ি মার কাছে উধ্বশ্বাসে দৌড়িয়া আসিল।
মা, আস্তাকুঁড়ে কত তরকারী কে ফেলে দিয়েছে তুমি দেখবে এসো।
দরিয়াবিবি হাঁস-মুরগিদের একমনে খুদ-কুড়া খাওয়াইতেছিল, সে যেন পুত্রের কথা শুনিয়াও শুনিল না।
পুত্র আবার এত্তেলা দিল।
দরিয়াবিবি তখন ধমক দিয়া বলিল, হাতে কাজ আছে দেখছিস নে? চোখ কি ফুটো হয়ে গেছে তোর?
আমজাদ মার থমথমে চেহারার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছিল, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা সমীচীন নয়।
তিন চার দিন আমজাদ নিরীহ ছেলের মতো ঘরে রহিল। মার এমন মূর্তি সে আর পূর্বে দেখে নাই। এমনভাবে কত দিন কাটিত কে জানে, আবার ইয়াকুব চাচার আগমনে সব শান্ত হইল। এবার সে একা আসে নাই। সঙ্গে পুত্র ও রসদসম্ভার আনিয়াছিল। তার ছেলের বয়স নয় কি দশ। আমজাদের প্রায় সমবয়সী। হঠাৎ পুত্র সঙ্গে কেন? দরিয়াবিবি অচেনা ছেলের সম্মুখে স্বাভাবিকভাবে অগ্রসর হইল, ইয়াকুবকে জিজ্ঞাসাবাদ করিল। দেবরের চাল বোঝার সাধ্যি দরিয়াবিবির নাই।
মোনাদির আবার পত্র লিখিয়াছিল। তাই পুত্রসহ বাড়ি ফেরার আগে দরিয়াবিবি ইয়াকুবের নিকট হইতে পনেরোটি টাকা চাহিয়া লইল।
আমজাদ বুঝিতে পারে, মার মেজাজ ঠিক হয় নাই। আজকাল সে বকুনি খায়, নঈমা–এমনকি শরী পর্যন্ত কান্নাকাটি করিলে প্রহার ভোগ করে। মা এমন ছিলেন না। একদিন সে আমিরন চাচির কাছে বেড়াইতে গিয়া অভিযোগ করিয়া আসিল।
কাজের চাপে কদিন আমিরন চাচি এই বাড়িতে আসিতে পারে নাই।
একদিন আসিয়া জেরা শুরু করিল, বুবু, তুমি নাকি ছেলেদের বড় মারধোর কর?
পোড়াজানে যদি মারধোর করি, কী অন্যায়টা করি? এগুলো মরলে আমার হাড় জুড়োয়।
আমিরন চাচি বাধা দিল, ছি ছি বুবু, এমন অপয়া কথা মুখে আনে! আমার একটা। সেও কম জ্বালায় না।
একটা আর দুটো। এরা জ্বালাতেই আসে। একজন তো মুখই আর দেখায় না। তার জন্য জ্বলছি। আর সঙ্গে যে কটা আছে, তারাও কম জ্বালাচ্ছে না। আল্লা এগুলো তুলে নিতে পারে না?
দরিয়াবিবি খুব অপ্রকৃতিস্থ। আমিরন চাচি কাজের বাহানায় সেদিন আর বেশিক্ষণ বাক্যালাপ করিল না। চলিয়া গেল।
দুপুরে কুঁড়া পায় নাই, উঠানে তাই কতগুলি মুরগি কটকট শব্দে কান ঝালাপালা করিতেছিল। দরিয়াবিবি ক্রোধে হাতের নাগালে পাওয়া একটি মুরগি ধরিয়া এক আছাড় দিল। আহত প্রাণী ঝটপট করিতে লাগিল।
নঈমা চোখে ভালো দেখে না, দাওয়ায় বসিয়াছিল। সে সেখানে হইতে বলিল, মা, মুরগি জবাই করছ? দরিয়াবিবি চিৎকার করিয়া উঠিল, দাঁড়া হারামজাদি, তোকে। জবাই করব।
আমজাদ এই সময়ে খেলা সারিয়া ফিরিতেছিল। সে মার হুঙ্কার শুনিয়া ধীরে ধীরে দহলিজের দিকে চলিয়া গেল। হাওয়া ফিরিলে, সেও ফিরিয়া আসিবে। আসিয়া বসিল আর নড়িতে চাহিল না। হাসুবৌর কাছে তো মোনাদির আর মুখ খুলিতে পারে না। হাঁ-না দিয়া জবাব দায়সারা করে। হাসুবৌ মোনাদিরের উদ্ধারে আসিল, চাচা, কথা বল, তুমি কেমন হয়ে গেছ।
মোনাদির মাথা হেঁট করিল। মার আদেশে সে আসিয়া চাচিকে সালাম করিয়াছিল। আর মুখ খুলিতে পারে নাই।
এমন লাজুক কেন, চাচা। আমিরন চাচি মোনাদিরের দিকে চাহিল।
পুত্রের বদলে জবাব দিল মা, বড় হয়েছে এখন সব বোঝে তো। মুরুব্বিদের সামনে কি বেশি কথা বলে? বেয়াদবী হয় যে!
তোমরা খেলা কর গে। যা, যা আম্বিয়া, যা। আমিরন চাচি মেয়েকে এক ঠেলা দিল।
আমজাদ মুনিভাইয়ের সঙ্গ পাইলে আর কিছু চায় না। সে বলিল, চল দাদা।
এতক্ষণে মনমতো প্রস্তাব আসিয়াছে। মোনাদির সাড়া দিতে বিলম্ব করিল না। আম্বিয়া তখন সলজ্জ ধীরপদে অগ্রসর হইতে লাগিল। কয়েক মুহূর্ত পরে সে এক দৌড়ে আমজাদ ও মোনাদিরের পথে অদৃশ্য হইয়া গেল। মেয়েরা হাসিয়া উঠিল। হাসুবৌ কহিল, চাচির মেয়ে একখানা। বড়া তাজা। দেখলে, কীভাবে দৌড় মারল।
যাক যাক। ও একটা জ্বালানি।
মেয়ের প্রশংসা মা সহ্য করিতে পারিল না।
বুবু, ছেলে এবার তোমার হল না? আমিও তো বলেছি, না এসে পারে?
আমার কোনো ভরসা নেই।
এমন অলক্ষুণে কথা মুখে এনো না।
দরিয়াবিবি কোনো জবাব দিল না, শুধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিল। চাচি আবার জিজ্ঞাসা করিল, কদিন থাকবে?
স্কুলের ছুটি আছে চারদিন। পরশু আবার চলে যাবে।
ও, বলিয়া আমিরন চাচি একটু চিন্তান্বিত হইল।
তোমরা খুব বুঝিয়ে বল, বোন। আবার যদি চলে যায়, আমি আর বাঁচব না।
হাসুবৌ ও আমিরন চাচি এক জোটে সায় দিল, নিশ্চয় বলব।
আম্বিয়া হি হি করিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া আসিল। তার দিকে সকলের লক্ষ্য।
এই পোড়ামুখি, হাসছিস কেন?
আম্বিয়া মার মধুর সম্বোধনে হাসি ক্ষ্যান্ত দিল। পরে বলিল, মুনিভাই গাছে চড়ে গান ধরেছিল। হঠাৎ একটা বাঁদর দেখে নামতে নামতে কাঠপিঁপড়ে কামড়েছে। তাই হাসি।
আবার কোথা থেকে মড়ার বাঁদর এসেছে। গাছপালা রাখা দায়। সেদিন আমার শিমগাছ খেয়ে গেছে। আমিরন চাচি উঠানের গাছপালার দিকে তাকাইল।
কথায় কথায় বেলা শেষ। মোনাদির ফিরিয়া আসিলে আজ চাচি নানা উপদেশ দিলেন। আম্বিয়ার জড়তা কাটিয়াছে। সে সকলের সঙ্গে খুব চাকুম চাকুম শব্দে মুড়ি ও নাড় খাইল।