এই আবর্ত দরিয়াবিবিকে টানিয়া লইয়া গেল ক্রমশ দিশাহারা পথে। এক ব্যাপারে সে নিশ্চিন্ত হইয়াছিল স্বামী আর নিরুদ্দিষ্ট প্রবাসী নয়। আজহার ফিরিয়া আসিয়াছিল মাত্র তিন সপ্তাহের মেয়াদ লইয়া। এক বছরে কত কি-না করিয়াছে। রাজমিস্ত্রী তার আদিম পেশা, ইটের পাঁজার সর্দারী, মসজিদের সহকারী আর মনোহারীর দোকান–তার আর এক মরীচিকা-মাখা শখ। নূতন মোড় ফেরার স্বপ্নে সে ফিরিয়া আসিয়াছিল। বাড়ি ফেরার আগে সে একটি দোকান পাতিয়াছিল। তার নিরীহ শান্ত মনেও তখন অস্থিরতার ছোঁয়াচ। নিজের দিকে সে নিজে চাহিতে শিখিয়াছিল। নামাজে মন থাকে না। জায়নামাজের পাটির উপর কখনো ঘুমাইয়া পড়িয়াছে সেজদা দিতে গিয়া। কেন এমন হয়? কোটাল চন্দ্র তো বিধর্মী। তার চেয়েও দুঃখী। কিন্তু সে আনন্দের অধিকারী। জীবনের ঝাপ্টা তার পাখনাকে পঙ্গু করিতে পারে নাই। অথচ-সে! বুকের ভিতর বাঁচা ও সংসার গোছানোর হাজার তৃষ্ণা লইয়া কলে-পড়া মূষিকের মতো পরিত্রাণের আশায় দিগ্বিদিক ছুটাছুটি করিতেছে। সকলের রুজি-দেনেওয়ালা আল্লার উপর তার বিশ্বাস কতটুকু? আজহার ক্লান্ত অবসর সময়ে নিজের কাছে এইসব প্রশ্নের জবাব খুঁজিত। শেষদিনে হঠাৎ দাম লইয়া এক খরিদ্দারের সঙ্গে ঝগড়াই করিয়া বসিল। পরদিন দোকান বিক্রয় হইয়া গেল। আবার গ্রামেই সে ফিরিয়া যাইবে। চন্দ্রের কাছে জিজ্ঞাসা করিবে, বাঁচার আনন্দ সে কোথা হইতে পায়? রহিম বখশ, হাতেম খাদের চন্দ্র ঘৃণা করে। এই ঘৃণার মধ্যে কী আনন্দ আছে? ঘৃণা তো হিংসা। এমন পাঁকের মধ্যে পদ্মফুল ফোটে? আর যা-ই করুক, চন্দ্রের সঙ্গে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষণ সে মিলাইয়া দিবে। সে তাড়ি খাক, নাচুক বা গান করুক, তা দেখার আবশ্যক নাই আজহারের। আজহার বুকে নূতন জোর পাইয়াছিল। মাঠের মাটির সঙ্গে সে কেন প্রবঞ্চনা করিবে না আর। জীবনের বোঝাঁপড়া হোক আবার। চন্দ্রের সঙ্গ আজহারকে উতোল করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু গ্রামে সে তো একা আসিল না। জেলা-জেলার ঘোরার ফলে বাঁকুড়ার দুরন্ত ম্যালেরিয়া আগেই দেহে বাসা বাঁধিয়াছিল। মাঝে মাঝে ভুগিতে হইত। পথেই নূতন প্রতিক্রিয়া শুরু। শেষ অঙ্ক মহেশডাঙায় অভিনীত হইল মাত্র।
নিরীহ ঈমানদার মানুষ– এইজন্য সমশ্রেণীর বন্ধুদের নিকট হইতে এই কয়েকদিন আজহার সহানুভূতি কম পায় নাই। চন্দ্র কোটাল প্রায়ই বসিয়া থাকিত বণ্টার পর ঘণ্টা। বাক্যালাপ হইত নামমাত্র। তবু তার উপস্থিতির কামাই ছিল না। রোগ ক্রমশ বাড়িতে থাকিলে এক মন্দিরের ঠাকুরের কাছ হইতে চন্দ্র গাছের শিকড় আনিয়া আজহারের হাতে বাঁধিয়া দিল। অন্য সময় কত আপত্তি করিত, হয়ত দুইজনের মধ্যে চটাচটি হইয়া যাইত। কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রী আজহার আর এক মানুষ। চন্দ্রের নিকট নিজেকে সঁপিয়া দিতেই তো সে গ্রামে আসিয়াছিল। এই বাড়িতে আসিলে চন্দ্রের ছোঁয়াচ হাসি কাহাকে না স্পর্শ করিত। কিন্তু চন্দ্রও আজকাল ভয়ানক গম্ভীর। একদিন দম-ভর তাড়ি খাইয়া আসিয়াও সে চুপচাপ বসিয়াছিল। কারো প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় নাই। তারপর আপন মনেই বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছিল। এই সংসারের ভবিষ্যৎ যেন এখনই তার সম্মুখে জিজ্ঞাসা-চিহ্নের মতো খাড়া। সহানুভূতি, এমনকি ইয়াকুবের কাছেও, সীমাতীত ভাবে পাওয়া গেল। সে পাঁচ মাইল দূর হইতে পাল্কি করিয়া পাস করা ডাক্তার আনিল। তখন শেষ অবস্থা। ডাক্তার কোনো আশা দিতে পারিল না।
দরিয়াবিবির একদা-তেজ যেন উবিয়া গিয়াছিল। অবশ্য গৃহস্থালীর কাজ ও সেবার কোনো ত্রুটি ছিল না। সে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রোগীর বিছানার পাশে আসিয়া বসিয়া থাকিত। কিন্তু আজহার নির্বিকার। নিজের প্রয়োজন সম্বন্ধে তার কোনো সচেতনতা ছিল না। দরিয়াবিবির দিকে একবার চোখ তুলিয়া চাহিয়াও দেখিত না সে। পাষাণের মতো নিঃসাড় খোলা দুই চোখ আর দেখার কাজে লাগে না যেন এখন তা চিরন্তন হাতিয়ার। দরিয়াবিবি কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করিলে হাঁ-না-রবে তার পরিসমাপ্তি হইত মাত্র। এই নীরবতা দরিয়াবিবিকে ভয়ানক চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছিল। স্বামীর কাছে নঈমা বা আমজাদকে ঘন ঘন পাঠাইত। কথা হইত শুধু নঈমার সঙ্গে। সে-ই যেন শুধু তার সব কথা বুঝিতে পারে। দরিয়াবিবি পিতা ও কন্যার কথোপকথনকালে উপস্থিত হইত। আজহার তখন নীরব। দরিয়াবিবি পাশে বসিয়া উঠিয়া আসিত ও অলক্ষ্যে চোখের পানি মুছিত। কত দায়িত্ব পিছনে পড়িয়া থাকিল, এই চিন্তা কি একবারও তোমার মনে জাগে না? দরিয়াবিবি ভাবিত, সে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখিবে। কিন্তু মুখ ফুটিয়া কিছুই বলিত না।
আজহারের গলায় কেমন ঘড়ঘড় শব্দ হইতেছিল। আজকাল সারারাত্রি পিদিম জ্বলে। দরিয়াবিবি উঠিয়া তখন জিজ্ঞাসা করিল, কষ্ট হচ্ছে?
না। তারপর আজহার দরিয়াবিবির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল, আমুর মা, আমি। কথা থামিয়া গেল।
দরিয়াবিবি তখন জিজ্ঞাসা করিল, তুমি আমাকে কিছু বলবে?
মাথা নাড়িয়া আজহার সম্মতি জানাইল ও পলকহীন চোখে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া রহিল। কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হইল।
অধীর দরিয়াবিবি সস্নেহে মাথায় হাত বুলাইতে শুধাইল, কিছু বলবে?
আজহার কোনো কথা বলিল না। শীর্ণ হাতখানি দরিয়াবিবির হাতের দিকে বাড়ানোর পথে আবার মুষ্ঠিবদ্ধ করিয়া লইল। চোখ তেমনই পলকহীন। রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোনো প্রতিধ্বনি ছিল না এই নীরবতার মুখোমুখি। এখনি এই ঠোঁট হইতে কথা ঝরিবে। দরিয়াবিবি আকুলি-বিকুলি করিতে লাগিল। কিন্তু আর কোনো কথা বলা হইল না। জীবন-যোদ্ধা পৃথিবীর কাছ হইতে ইত্যবসরে ছাড়পত্র পাইয়াছিল। শুধু চোখ দুটি তখনো সজীব। দরিয়াবিবি তাহা বুঝিতে পারে নাই। মৃত স্বামীর চোখের দিকে দৃষ্টি পাতিয়া সে চাহিয়া রহিল, চাহিয়া রহিল।