দুপুর বেলা মাঠে কেউ থাকে না। এতক্ষণ আপনমনে চন্দ্র গান করিতেছিল। কিন্তু বাড়ির কাছে হঠাৎ গান বন্ধ হইয়া গেল। গায়ক পর মুহূর্তে যোদ্ধা সাজিয়াছে। কোটাল পোড়া চেলা কাঠখানি বাই-বাই শব্দে ঘুরাইতেছে আর মুখে হট-যাও, হট যাও রব।
চন্দ্রমণি, তার ছেলেরা আর কোটালের স্ত্রী হঠাৎ হিন্দি চিৎকার শুনিয়া ঘরের বাহিরে আসিল। প্রথমে বিস্ময়, তারপর সকলে তামাশা দেখিতে লাগিল। চন্দ্রমণির দুই ছেলে মামার কাণ্ড দেখিয়া হাসিয়া খুন। কোটালের স্ত্রী কিন্তু খুব চটিয়াছিল। তাড়ি তো চন্দ্র কোটালের কাছে জল। আপত্তি সেখানে নয়। এই অবেলায় মড়াকাঠ কাঁধের উপর! এমন অলুক্ষণে কাণ্ড কোটাল-স্ত্রীর সহ্যের বাহিরে।
সেও চিৎকার করিয়া বলিল, তুমি এসো ঘরে, তোমার হট-যাও আমি বের করব। চন্দ্রমণির চোখ ভ্রাতৃজায়ার দিকে। ছি ছি, দাদার যত বয়স বাড়ছে, তত ঢিটেমি বাড়ছে।
তুমি ঐ কাঠ নিয়ে ভিটের উপর একবার ওঠো দেখি। কোটাল-গিন্নী শাসাইতে লাগিল।
চন্দ্র হঠাৎ চেলাকাঠ ঘুরানো থামাইল, তারপর চিৎকার করিয়া শুধাইল, কিয়া হুয়া।
কিয়া হুয়া? তোমার হুক্কাহুয়া বের করব, একবার ওঠো দেখি। কোটাল আবার যোদ্ধার হুঙ্কারে চেলাকাঠ ঘুরাইতে লাগিল। কিন্তু ভিটার নিকটে কয়েকটা চারা করঞ্জা গাছের কাছে আসিয়া থামিল। যোগীন তখন মামার উদ্দেশে ডাক দিল, মামা, উপুরে এসো না, মামী মারবে।
চুপ বেটা। আমি জমিদার হ্যাঁয়, হ্যামকো কোন রোকেগা। কাঁধে গদা লইয়া ভীমের মতো চন্দ্র সটান খাড়া হইল। বাবরী চুল বাতাসে এলোমেলো। চক্ষু দুটো নেশার ছলকে গোল ভাটার মতো। যোগীর ছোট ভাই তো রীতিমতো ভয় পাইয়া মার আঁচলে আশ্রয় লইল।
ভিটার উপরে কোটাল-পত্নী কোমরে কাপড় জড়াইয়া হুংকার ছাড়িল, মড়াকাঠ ফেলে ভালো মানুষের মতো আবার নদীতে স্নান করে এসো। না হলে স্ত্রীর বদ্ধমুষ্টি, চন্দ্র ভালোরূপে ঠাহর করিল।
হট-যাও, হাম জমিদার হ্যাঁয়। তারপর কোটাল সমস্ত মাঠের দিকে আঙুল অর্ধবৃত্তাকারে বাড়াইয়া বলিল, হট যাও, সমস্ত জমি আমার হ্যাঁয়। ইয়ার্কি পায়া হায়– রোকদেগা।
একবার ভিটের উপর উঠে দ্যাখো। কোটাল পত্নী ভ্যাংচাইয়া বলিল।
কোটাল জবাব না দিয়া চেলাকাঠখানির সাহায্যে ধাই ধাই চারা গাছগুলি পিটাইতে লাগিল আর সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার–এইসব আমার প্রজা আছে-বাত নেই শোন্তা? কিছুক্ষণ এই তরুপ্রজা ঠ্যাঙ্গানো চলিল। ভিটার উপরে সকলে তখন বেদম হাসিতে শুরু করিয়াছে।কোটালের বীরোচিত শৌর্যের উৎসাহ আরো বাড়িয়া যায়।
গিন্নী চিৎকার দিল, এই পাগল পাগল।
পাগল! যোদ্ধা মুগুর উঁচাইয়া থামিল। প্রথমে ব্যঙ্গের হাসি, পরে চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে হুঙ্কার ছাড়িল, পাগল! জমিদার শালা পাগল?
পাগল, পাগল।
ছেলেরা চিৎকার দিয়া হাসিল, পাগল, পাগল!
সব মার ডালেগা–বলিয়া মুগুর-বিশারদ আবার কল্পিত প্রজাদের শায়েস্তা করিতে লাগিল। নেশা বেজায় চড়িয়াছিল।
প্রতিপক্ষ তখন হাসিয়া লুটাইবার উপক্রম। সুযোগ বুঝিয়া চন্দ্র ভিটার দিকে এক পা অগ্রসর হইল। তখন গিন্নী একটা চেলাকাঠ লইয়া দাঁড়াইল।
চন্দ্র চিৎকার দিয়া বলিল, পাগল না হলে মানুষ ঠ্যাঙায়? সব মার ডালো।
আবার মুগুরবাজি চলিল।
খিলখিল নারী হাস্যে তখন অবেলার রঙ আরো ঘন হয়।
কতক্ষণ এমন চলিত কে জানে? এই সময় আমজাদ ভিটার পথে উপস্থিত হইল। দরিয়াবিবির জরুরি আদেশেই সে এই দিকে আসিয়াছিল। ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়া গেল। কাকার নূতন কীর্তি। কিন্তু সে রণদেহি মূর্তি দেখিয়া বেশ ভয় পাইয়াছিল। মার আদেশ হাতে করিয়াই ফিরিয়া যাইবে কিনা ভাবিতেছিল। হঠাৎ যোদ্ধার নজর সেদিকে গেল।
প্রজারা নিস্তার পাইল। মুগুর উঁচাইয়া মহাবীর আমজাদের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। আমজাদের ভয়ে মুখ শুকাইয়া যায়। সে সাহসের উপর ভর দিয়া বলিয়া ফেলিল, কাকা আপনাকে মা ডাকছে। খুব দরকার।
যোদ্ধার কানে যেন কথাটা গেল না। গজেন্দ্র-গমন ও স্কন্ধ-শোভিত গদা অবিচল থাকে।
কিন্তু চন্দ্র ভয়ের ফুরসৎ দিল না। হঠাৎ গদা ফেলিয়া সে আমজাদকে কাঁধে তুলিয়া লইল। ছেলেবেলা বেশ মজা লাগিত! এখন আমজাদ কিশোর, তার বড় লজ্জা করে। কাকা, আমাকে নামিয়ে দাও। সে মিনতি জানাইল। কিন্তু নেশাখোর নিজের খেয়ালে বিভোর। কবিগানের সর্দার তখন গান ও নৃত্য জুড়িয়া দিয়াছে।
চাচা এল অবেলায়।
এখন কোথায় কি পাই?
খেতে দেওয়া দায়।
হাঁস রয়েছে পুকুর পাড়ে
মুরগি আর ডিম না পাড়ে
ঝোপে-ঝাড়ে বন-বাদাড়ে
শেয়ালছানাও নাই।
চন্দ্র হঠাৎ মাথা ঝাঁকুনি দিয়া বলিয়া উঠিল, তওবা, মুসলমানের ছেলে। তারপর ওয়াকশব্দে থুথু ফেলিল। গানের নূতন কলি শুরু হয়।
ভাইপো তুমি কর না ভাবনা
আমি ওসব কিছুই খাব না।
ঘরে আছে মুটকী চাচী
তারে কর না জবাই ॥
আহা চাচা, আক্কেল বটে
বলিহারি, বলিহারি যাই ॥
চন্দ্র খাঁ-পাড়ার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। ভিটার উপর হাসির মওজ ছুটিল। পড়ন্ত বেলা। দিকে দিকে রঙ লাগিয়াছে। ঝাঁকুনি খাওয়া গান মাঠে মাঠে রেশ রাখিয়া যায়।
ঘরে আছে মুটুকী চাচী
তারে কর না জবাই।
সলজ্জ, তবু আমজাদ কাঁধের উপর হাসিতে লাগিল।
.
৩৩.
বছর ঘুরিয়া গেল।
সূর্য-প্রদক্ষিণ শুধু স্থাবর-জঙ্গমের সহগামী নয়। সংসারের বিচিত্র প্রক্ষেপও সঙ্গে সঙ্গে অগ্রসর হয়। সচ্ছলতা-অনটন, হাসি-কান্না বিচিত্র ছন্দ তার দাগ রাখিয়া যায়।