অভ্যেস আর সহজে যায়! সেদিন খামাখা আমার ঝাড়ের দুখানা বাঁশ কেটে নিল। নিক, ওর ছেলের কবরে লাগবে। আমিরন চাচির গলা হইতে যেন এক ঝলক আগুন বাহির হইল।
দরিয়াবিবিও ঘৃণা প্রকাশ করিল, বেওয়া মানুষ, তাকে দুগাছি এনে দেওয়া দূরে থাক, তারই চুরি, এসব সইবে না।
ওদের সয়। পরের মেরে মেরে বড় হচ্ছে। এদিকে লেফাফা ঠিক আছে। আজকাল আবার মসজিদের মুয়াজ্জিনগিরি করে।
নঈমার চোখ দিয়া পানি পড়ে। সে দৌড়াদৌড়ি আর ভালোবাসে না। চাচি দুটি মোয়া দিয়াছিল। সে তা চিবাইতে ব্যস্ত। বোধহয় গলায় বাঁধিয়াছিল, তাই চাচির নিকট পানি চাহিল।
কথায় ছেদ পড়িল। দরিয়াবিবি তখন চাচির উঠানের চারিদিকে চাহিয়া থাকে। এখানে আসিলে সত্যি, বুকে জোর পাওয়া যায়। বিধবা মানুষ। অথচ সংসার বেশ চালাইয়া যাইতেছে। উঠানটি নিখুঁত পরিষ্কার থাকে। আশপাশে সজি আনাজের গাছ। গত বছর চাচি একটি লেবু গাছ লাগাইয়াছিল। তা-ও পত্র-সম্ভারে বাড়িয়া উঠিয়াছিল। সংসার বড় নয়, এইজন্যই আমিরন সামাল দিতে পারে। দরিয়াবিবি ভাবিতে লাগিল।
আমিরন চাচি পানির গ্লাস নঈমার হাতে দিল।
ওর জন্য আবার গ্লাস দিয়েছ, এখনই ভাঙবে। দরিয়াবিবি সাবধান করিল।
আমিরন চাচি আপত্তি জানাইল, আমি ধরে আছি। ঘরে কিইবা আছে বুবু। এই গ্লাসটা, তোমার ভাই তখন বেচে হরিশপুরের মেলা থেকে এনেছিল।
আমার ঘরেও সব ভেঙেছে। পুরাতন কাঁচের দুচারটে জিনিস আছে, তুলে রেখেছি। কেউ মানুষ জন এলে বের করতে হয়। দরিয়াবিবি সায় দিল।
আমিরন চাচির সময় কম। বিকালে গরু বাছুরের খবরদারীতে বহু সময় যায়। শাজসজির গাছ আছে আশপাশে; পানি না দিলে চলে না। চাচি তাই দ্রুত কথা বলিতেছিল। আজ মোনাদির কি আজহারের প্রসঙ্গ আমিরন চাচি মুখ দিয়া বাহির করিল না, পাছে দরিয়াবিবি কষ্ট পায় বা হঠাৎ কেঁচো খুঁড়িতে সাপ বাহির হয়।
কিন্তু কথা প্রসঙ্গে এই সাপই ছোবল তুলিল।
আমিরন চাচি বলিতেছিল, বুবু, একা মানুষ হলে আমি কি ভয় পেতাম। তেমন ডরানেওয়ালী মায়ে পয়দা করেনি। কিন্তু ঐ যে-এক গলার কাঁটা রয়েছে।
দরিয়াবিবি কথাটা ঠাহর করিতে পারিল না সহজে। গলার কাঁটা। বিস্ময় প্রকাশ করিয়া সে চাচির মুখের দিকে তাকাইল।
আমিরন চাচি হাসিয়া উঠিল। তুমি আমার গলার কাঁটা দেখনি? বলিয়া আবার হাসিতে লাগিল। দরিয়াবিবি খামাখা হাসে, আর সত্যিই চাচির কণ্ঠনালীর দিকে তাকায়।
আমিরন চাচি হাসে আর বলে, তুমি ডাক্তার হেকিম হলে আমার কাঁটা দেখতে পেতে।
আমাকে আগে বল নি, বুবু! দরিয়াবিবির বিস্ময়ের অবধি নাই। আমিরন চাচি আরো হাসিতে থাকে। আর বিশেষ বেলা নাই। তাই বলিল, দাঁড়াও বুবু, গলার কাঁটা দেখাচ্ছি। অ আম্বিয়া, অ আম্বিয়া। শেষের দিকে চাচি চিৎকার জুড়িল।
নিকটেই ছিল, আমজাদ ও আম্বিয়া আসিয়া উপস্থিত। ঐ আমার গলার কাঁটা, চাচি আম্বিয়ার দিকে আঙুল বাড়াইল।
কি মা? আম্বিয়া খেলা ছাড়িয়া আসিয়াছে। এখানে দাঁড়াইতে রাজি নয়।
যা, খেল গে।
ছেলেমেয়ে দুটি আবার দৌড়াইয়া পালাইল। তখন দরিয়াবিবি হাসিতে হাসিতে বলে, তুমি লোককে এমন বোকা বানাতে পারো।
গলার কাঁটা নয়? একা হলে ঝাড়া হাত পা যা খুশি করতাম। যেমন ইচ্ছে থাকতাম। বুবু, এখন কত কথা ভাবতে হয়। মাঝে মাঝে রাত্রে শুয়ে শুয়ে ভাবনায় নিদ ধরে না। চাচির মুখের উপর দিয়া ছায়া খেলিয়া গেল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া দরিয়াবিবি বলিল, বুবু, আমার কতগুলো দ্যাখো। সব তো বেঁচে নেই। এইগুলো তো আমার পায়ের বেড়ি। কবছরে কি যেন হয়ে গেলাম।
তবু ওদের ছাড়া ঘর মানায় না। হাসুবৌটার দশা দ্যাখো। সোয়ামির চোখের বালি, শাউড়ীর কাঁটা। একটা ছেলেপুলে নেই।
ও বেশ আছে। যার নেই, তার এক ধান্দা। যার আছে তার শতেক ধান্দা।
হক কথা বুবু।
আমার মুনিটা এখানে থাকলে, আমি কোনো কিছুতেই ভয় পেতাম না।
আমিরন চাচি এই প্রসঙ্গ এড়াইতে চায়। কিন্তু দরিয়াবিবি রেহাই দিল না।
মুনি থাকলে, আমি আম্বিয়াকে ঘরে নিয়ে যেতাম। কি তোমার কাছেই থাকত। তোমার আর কেউ নেই–একটা ছেলে সংসারে বাড়ত।
আমিরন চাচি যেন চাঁদের স্বপ্নে বিভোর। বলিল, বুবু, তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ক। আহ্ আমার কি সে কপাল হবে। তুমি রাজি হলেও, খাঁ ভাই? তোমার উঁচু খাঁ বংশ।
তালপুকুর ঘটি ডোবে না। বেশ ব্যঙ্গসুরে দরিয়াবিবি বলিল, আমার ছেলের বিয়ে দিলে কে কী বলবে? সে তো আর মোনাদিরের বাপ নয়।
আমিরন চাচি বড় খুশি হয়। কিন্তু মিথ্যা কল্পনা, তা উপলব্ধি করেও।
কিন্তু ছেলেটা চলে গেল–
দরিয়াবিবি বড় বিষণ্ণ হইয়া পড়িল। আমিরন চাচি তাড়াতাড়ি ছেলেদের ডাকিয়া নাড় খাওয়াইল। সেই হট্টগোলে সহজ আবহাওয়া ফিরিয়া আসে। সন্ধ্যা হইতে আর দেরি নাই। দরিয়াবিবি কাজের মর্যাদা জানে। চাচিকে সে ছুটি দিল।
পৃথিবী কত বড়। পাল্কি-জানালার ফাঁক দিয়া কতটুকু আর দেখা যায়। ঝোপে ঝোপে এই সড়ক পথে হাঁটিবার সময় আমজাদের মতো দরিয়াবিবিও অদ্ভুত আস্বাদ পায়।
গা-ঢাকা সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। জঙ্গলে জঙ্গলে তখন জোনাকিরা প্রদীপ কাড়াকাড়ি শুরু করিয়াছিল।
.
৩২.
চন্দ্র একরাশ তাড়ি গিলিয়া বাড়ি ফিরিতেছিল। ভিটার কাছাকাছি আসিতে দেখা গেল, তার ঘাড়ে একটি আধপোড়া চেলা কাঠ। শ্মশান হইতে চন্দ্র তুলিয়া লইয়াছিল, তা আর বুঝিতে দেরি হয় না।