আজহার ইতস্তত করিতেছিল। সদ্যপ্রসূত ছাগীর সংস্পর্শ তার ভালো লাগে না।
অত বাবুয়ানি যদি করতে চাও করো। ছেলেদের মানুষ করবে, না নিজের মতো গরুর লেজ-মলা শেখাবে?
যাক না রাত্রের মতো। খালি বাচ্চা দুটো নিয়ে যাই।
দরিয়াবিবির কণ্ঠস্বর ঝংকৃত হয় : নাও তুমি বাচ্চা দুটো, আমি ধাড়িটা কোলে নিচ্ছি।
দরিয়াবিবির অবয়বের বাঁধন ভালো। ছাগলটিকে সে সহজেই বহন করিতে সমর্থ হইবে। আনন্দে তার কর্মব্যস্ততা আরো বাড়িয়া যায়।
কয়েক কাঠা জমি অগ্রসর হওয়ার পর মুশকিল বাধিল ডিপা লইয়া। আজহার খাঁর বুকে ছাগশিশু দুইটি। ডিপা আবার ধুচনির ভিতর সাবধানে না রাখিলে চলে না। একটু হাত কাঁপিলে বাতাসে নিভিয়া যাইবে।
ভয়ানক রাগিয়া উঠিল দরিয়াবিবি। শেয়ালকুলের ঝোঁপ পার হওয়ার পর দমকা বাতাসে ডিপা নিভিয়া গেল।
ঐ কাজ তোমাকে দিয়ে হয়! বাচ্চা দুটো আমাকে দিতে কী হয়েছিল?
আজহার খাঁ আর জবাব দেয় না। অন্ধকারে কোনো রকমে দুইজন অগ্রসর হয়।
কালো মেঘের পঙ্গপাল হুড়ুম-দুড়ুম গ্রামের উপর ভাঙিয়া পড়িতেছে। বৃষ্টি নামিলে দুরবস্থার আর অন্ত থাকিবে না।
অন্ধকারে দরিয়াবিবি বারবার আল্লাহর নাম করে। নঈমা একা ঘরে শুইয়া রহিয়াছে। পচা ছিটেবেড়ার ঘর। দরিয়াবিবির সমস্ত রাগ আজহার খাঁর উপর। চোখে তার জল আসে। এমন অবোধ মানুষকে লইয়া তার সংসার!
দরিয়া-বৌ, আর বেশি দেরি নেই।
বিদ্যুতের আলোকে পথ দেখা গেল। পুকুরপাড় শেষ হইয়াছে।
এইবার নামিল ঝমঝম বৃষ্টি। চেনা সরল পথ। আজহার খাঁ দৌড় দিল। ভারী ছাগ দরিয়াবিবির কোলে, সে ঝড়-বৃষ্টি মাধায় সন্তর্পণে চলিতে লাগিল।
উঠানে আসিয়া দরিয়াবিবি দেখিল, টাটি বাতাসে খুলিয়া গিয়াছে। ইন্তার পাতাপুতি ঢুকিতেছে ঘরে। নঈমা অন্ধকারে হাউমাউ জুড়িয়াছে। আসেকজান চেঁচাইতেছে। তার কথার কোনো হদিশ নাই।
ছাগলটিকে মাটির উপর রাখিয়া দরিয়াবিবি ধূলার উপর উপবেশন করিল। জায়গার বাছবিচার নাই তার। বড় শ্রান্ত সে।
আজহার খাঁ ডিপা জ্বালাইয়া মাদুরের উপর বসিয়া পড়িয়াছিল। তেলচিটা দাগ-লাগা বালিশের একপাশ হইতে কালো তুলা বাহির হইয়া পড়িয়াছে। শুইয়া পড়িল আজহার খাঁ।
ক্লান্ত দরিয়াবিবি করুণ দৃষ্টিতে বারবার স্বামীর মুখ অবলোকন করিতে লাগিল।
.
০২.
এক পশলা বৃষ্টি হইয়াছিল রাত্রে। আজহার সকালেই লাঙল কাঁধে মাঠে চলিয়া গিয়াছে। এক মাইল দূরে তার জমি। দুপুরের রৌদ্রে বাড়ি ফিরিয়া খাওয়াদাওয়া করা যায়; কিন্তু আবার মাঠে ফিরিয়া আসা পণ্ডশ্রম। এইজন্যে আমজাদ দুপুরের ভাত মাঠে লইয়া যায়। দরিয়াবিবি তা পছন্দ করে না। আমজাদের মখতব যাওয়া হওয়া না। লেখা-পড়া নষ্ট। অন্য উপায়ও নাই। দরিয়াবিবি গৃহস্থালির কাজ করিতে পারে। পর্দানশীনা মেয়েদের মাঠে যাওয়া সাজে না।
আমজাদের কিন্তু এই কাজ খুব ভালো লাগে। দহলিজের একটেরে বসিয়া থাকা ভারি কষ্টকর। মাধা ধরে, হাই ওঠে, তবু মৌলবী সাহেব ছুটির নাম করেন না। এখানে ইচ্ছামতো দেদার মাঠে ঘুরিয়া বেড়ানো, তার চেয়ে আনন্দের আর কি আছে পৃথিবীতে!
ঠিক মাঝামাঝি দুপুরে আমজাদ নিজে খাইতে বসে। ছেলেমানুষের বিশ্রাম প্রয়োজন হয়। কোনো কোনো দিন দুপুর ঢলিয়া যায়।
আজহার অবশ্য তার জন্য রাগ করে না। আমজাদ মাঠে পৌঁছাইলে হাসিমুখেই সে বলে : আমু, এত দেরি কেন, ব্যাটা?
রাঁধতে দেরি। আর আমি জোরে হাঁটতে পারি না।
আজহার গামছায় ঘর্মাক্ত কচিমুখ মুছাইয়া বলে, থাক, তার জন্যে কী হয়েছে! আমার ভারি পিয়াস পেয়েছে, একটু পানি আনো তো নদী থেকে।
জমির পাশেই নদী। দরিয়াবিবি আমুর হাতে একটা ছোট বদনা দিতে ভোলে না। অন্য সময় আজহার আঁজলা করিয়া পানি পায়। খাওয়ার সময় এই হাঙ্গামা পোষায় না।
আমজাদ পিতার আদেশ পালন করে। দুপুরের চড়া রোদ। সেও কম ক্লান্ত হয় না। মতবের জেলখানা হইতে সে রেহাই পাইয়াছে, এই আনন্দে নিজের শ্রান্তির কথা ভুলিয়া যায়।
কয়েত-বেলের গাছের ছায়ায় আজহার খাঁইতে বসে।
বন্যার সময় দুইটি কয়েত-চারা ভাসিয়া আসিয়াছিল পাঁচবছর আগে। আজহার নিজের হাতেই বানভাসি চারা দুইটি রোপণ করিয়াছিল। ঝকড়া গাছের ছায়ায় অন্যান্য বিশ্রান্ত কিষাণদের গুলজার মজলিশ বসে। জমির আর এক কোণে কলার গাছ। ভালো কলার গাছ রোপণ বৃথা। রাত্রে চুরি হইয়া যায়। এইজন্যে মাঠে কেউ ভালো কলার গাছ লাগায় না। পূর্বে কলাপাতার ছায়ায় আজহার মধ্যাহ্নভোজন করিত। গাঁয়ের আরো কিষাণ মাঠে আসিয়া বাস করিতেছে। তারা সকলেই বাগদী, তিওর শ্ৰেণীর। আজহারও মাঠে বসবাস করিতে চায়। ফসলের খবরদারি ভালো হয়, ইচ্ছামতো পরিশ্রম করা যায়। দরিয়াবিবি রাজি হয় না। বেপর্দা জায়গায় ইজ্জত রাখা দায়। তার উপর পুষ্করিণী নাই। নদীর তট এই দিকে উঁচু। গ্রীষ্মকালে পানি ঢালু তটের দিকে সরিয়া যায়। মুমিনের ঘরের মেয়ে এতুটুক বেপর্দা হইতে পারে না। বাগদী তিওরেরা কোনো অসুবিধা ভোগ করে না। মার সঙ্গে উলঙ্গ কুঁচো ছেলের দল দুপুরের স্নান করিতে যায়। রসিক বাদীর দুইটি ছেলে কয়েক বছর আগে বন্যার সময় ভিটার উপর হইতে স্রোতে পড়িয়া গিয়াছিল। তাদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া গেল না। ভিটে-ত্যাগের কথা উঠিলে দরিয়াবিবি এই কাহিনী খুব ফলাও করিয়া বলে, আজহার খাঁর উৎসাহ থাকে না আর।