বড় পাতলা ঘুম আসেকজানের। দৃষ্টিশক্তি অল্প বলিয়া আমজাদের খবরদারি সে করিতে পারে না। দরিয়াবিবি তাই অনেক রাত্রে উঠিয়া গিয়া দেখিয়া আসে। কামরার সংলগ্ন ছিটেবেড়ার ঘর। মাঝখানে একটি বাঁশের চোরা-টাটি আছে। যাতায়াতের কোনো অসুবিধা নাই। আমজাদের শোয়া খারাপ। গড়াইতে গড়াইতে হয়ত ধুলোর উপর শুইয়া থাকে। ডিপা হাতে আজও দরিয়াবিবি আমজাদকে দেখিতে আসিল। না, সুবোধের মতো সে ঘুমাইতেছে।
পা-তালির শব্দে আসেকজানের ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল।
কে, আজহার?
না, আমি দরিয়া, খালা।
এত রাত্রে কেন, বৌ!
এমনি এলাম।
সারাদিন কাজ। যা, ঘুমো গে, বাছা।
আচ্ছা, যাই।
আসেকজান আবার সাড়া দেয় : বৌ, এলে যখন একটু পানি দাও না, মা। বুড়ো মানুষ আঁধারে হাতড়ে মরব।
আসলে আসেকজানের খুব কষ্ট হয় না অন্ধকারে। দুই ঘরে ডিপা জ্বালানোর কেরোসিন ব্যয় এই সংসারের পক্ষে দুঃসাধ্য। আসেকজান পীড়াপীড়ি করে না। সব তার অভ্যাসের কাছে পোষ মানিয়েছে। আঁধারে আঁধারে সে পুকুরঘাট পর্যন্ত যাইতে পারে।
দরিয়াবিবি কলসের পানি ঢালিয়া দিল।
বৌমা, কাল একটু ও-পাড়া যাব। কেউ যদি একটা কাপড় দেয়। সেই আর বছর ঈদে কখন মোসলেম মুনশী একখানা দিয়েছিল। আল্লা তার ভালো করুক।
দরিয়াবিবি মাঝে মাঝে ভারি কঠিন হয় বুড়ির উপর। এত রাত্রে আর গল্পের সময় নাই। দরিয়াবিবির অন্তর্ধানে আবার ঘরটি অন্ধকারে ভরিয়া উঠিল। শব্দের ভারসাম্য রাখিতে পারে না আসেকজান, নিজে বধির বলিয়া। সে চেচাঁইয়া বলিতে থাকে, মড়ার দিনকাল কী হল? একটা একটাকা পাঁচসিকের কাপড়ও লোকের সত্যেয় ওঠে না। আখেরি জামানা! দজ্জাল আসতে আর দেরি নেই। চৌদ্দ সিদির (শতাব্দী) আমল, কিতাবের কথা কি আর ঝুট হবে?
অনেকক্ষণ পরে আসেকজান বুঝিতে পারে, ঘরে কেহ নাই। তখন নিজেই স্তব্ধ হইয়া যায়। শাদা চুলের উকুন বাছিতে বাছিতে আসেকজান দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে।
অখ্যাত পল্লীর নিভৃতে মানুষের আহাজারি-বুকে নৈশ বাতাস একটানা বহিয়া যায়।
দরিয়াবিবির আশঙ্কা অমূলক নয়। নিশুতি রাত্রে আবার ছাগলের অবিশ্রান্ত চিৎকার শোনা গেল।
দরিয়াবিবির পক্ষে বিছানায় পড়িয়া থাকা মুশকিল। যদি সত্যই ছাগলটির বাচ্চা হয়। সে একা সামাল দিতে অপারগ। স্বামীকে জাগাইতে হইল।
ঐ শোনো। ছাগলটা আকুলিবিকুলি করছে।
আজহার খাঁ উঠিয়া পড়িল।
না, গিয়ে দেখাই যাক। ডিপাটা জ্বালো।
দরিয়াবিবি স্বামীর আদেশ পালন করিল।
টাঁটি খুলিয়া আজহার খাঁ দেখিল, আকাশে দ্রুত মেঘ জমিতেছে। দমকা বাতাস হু। হু শব্দে বহিতেছে।
দরিয়া-বৌ, ডিপা নিয়ে যেতে পারবে? খুব বাতাস।
ঘরে কোণায় একটি ধুচনি ছিল। ডিপাটি তার মধ্যে রাখিয়া স্ত্রী জবাব দিল : চলো, আমি বাতাস কাটিয়ে যেতে পারব।
পুকুরের পাড়ের পথ তত সুবিধার নয়। দুপাশে ঘন জঙ্গল। সাবধানে পা ফেলিতে হয়। ধুচনির ভিতর ভিজা আলো তাই স্পষ্টভাবে চারিদিকে ছড়াইয়া পড়ে না। ছাগলের চিৎকার আর যেন থামা জানে না।
জোর ঝড় উঠিতে পারে যে-কোনো মুহূর্তে। পুকুরপাড়ের গাছপালা ভাঙিয়া পড়িতেছে। নিশুতি বনভূমির প্রেতাত্মা খলখল হাস্যে উন্মাদ নৃত্য-তাণ্ডবে মাতিয়াছে যেন। চারিদিকে গোঙানির শব্দ ওঠে।
দরিয়াবিবি ভয় পায় না। ডিপা হাতে সাবধানে পা ফেলে সে।
না, এবার থেকে গোল ঘর সরিয়ে আনব ভিটের কাছে।
আজহার খাঁ বলিল। কথার খেই সে আবার নিজেই অনুসরণ করে : জায়গা পাব কার? তবু রায়েদের ভালোমানুষি যে, পুকুরপাড়ে গোল করতে দিয়েছে।
দরিয়াবিবি ডিপা সামলাইতে ব্যস্ত। কোনো কথা তার কানে যায় না। পাড়ের উপর শেয়াকুলের ঝোঁপ আড় হইয়া পড়িয়াছিল। আজহার ভাঙা পিঠুলির ডাল দিয়া কোনোরূপে পথ পরিষ্কার করিল। অতি সন্তর্পণে পা-ফেলা ছাড়া উপায় থাকে না। কাঁটাকুটিতে পথ বোঝাই হইয়া গিয়াছে।
আরো দমকা বাতাস আসে। গাছপালাগুলি যেন মাথার উপর ভাঙিয়া পড়ে আর কী।
এইখানে পথ বেশ পরিষ্কার। দরিয়াবিবি দ্রুত পা চালায়।
গোয়ালঘরের সম্মুখে আসিয়া তারা হাঁপ ছাড়ে। ছাগমাতার চিৎকারও আর শোনা যায় না।
গোয়ালের টাঁটি খোলা-মাত্র একটা শাদা বাছুর সম্মুখের তালবন হইতে ছুটিয়া আসিল।
হতভাগা, কোথা ছিলি সাঁজবেলা?
আজহারের গা ঘেঁষিয়া বাছুরটি লেজ দোলায়। মানুষের ভর্ৎসনা বোধহয় আদরের পূর্বলক্ষণ। দরিয়াবিবি বাছুরের গলায় দড়ি পরাইয়া দিতে লাগিল। নচেৎ সব দুধ শেষ করিয়া ফেলিবে।
প্রথমে গরুর কুঠরি ছাগলের কুঠরি একঘরে। ওই দিকটা আরো অন্ধকার। গোয়ালের চালে ঝড় খুব কম লাগে। চারিদিকেই প্রায় ঘন চারা তালগাছের সারি। বাতাস এই দুর্গ সহজে ভেদ করিতে পারে না।
দরিয়াবিবি ডিপা লইয়া ছাগলের কুঠরিতে ঢুকিল। আনন্দে তাহার দুই চোখ উজ্জ্বল হইয়া উঠে। অসহায় ছাগমাতা দণ্ডায়মান। সম্মুখে দুইটি কালো ছাগশিশু। পশুমাতা গা লেহন করিতেছে শিশু দুইটির।
এখনও ফুল পড়ে নাই। দরিয়াবিবি তাই বলিল, এক কাজ করা যাক, ফুলটা আমি ফেলে দিই, না হলে বাচ্চাগুলোর কী দশা হবে যদি ফুল খেয়ে বসে থাকে? দুধ কিনে বাচ্চা বাঁচানোর পয়সা আছে আমাদের?
দরিয়াবিবি আর বিলম্ব করে না। ধাত্রীর কাজ সে নীরবেই সম্পন্ন করিল।
চলো, আরো ঝড় উঠতে পারে। তুমি ধাড়িটাকে কোলে নাও। আমি বাচ্চা দুটো আর ডিপা নিই।