এক কাজ করো না, ওজু করতে একটু ডানধারে সরে যাও। কতগুলো ছাঁচি কদুর বীজ পুঁতেছিলাম, কড়ে আঙুলটাক গাছ বেরিয়েছে। পানি তো রোজ দিই। আজ একটু ওজুর পানি পড়ক। আর হুজুরের কদম-ধোওয়া পানি।
আজহার খাঁ কোনো কথা না বলিয়া উঠানের দক্ষিণদিকে ওজু করিতে বসিল। দরিয়াবিবির এত হাসি তার ভালো লাগে না।
রান্না শেষ। চুলার ভিতর পাতার আগুন। দরিয়াবিবি একটা হাঁড়ি চুলার মুখে বসাইয়া দিল, পাছে বাতাস ঢোকে। রাত্রির মতো দরিয়াবিবির কাজ চুকিয়াছে।
আর এক লোটা পানি আনিল সে। আমু খেয়ারে ঢুলিতেছিল। তার মুখে পানির ছিটা দিয়া দরিয়াবিবি বলিল, একটু হুঁশ কর বাবা, আর দেরি নেই। আজ তো একটু পড়তেও বসলি নে।
নঈমা তখনও খুঁতখুঁত করিতেছে।
একটু সবুর কর মা। ঘাট থেকে মুখে-হাতে পানি দিয়ে আসি।
আজহার খাঁর নামাজ-পড়া শেষ হইয়াছিল। নামাজের ছেঁড়া পাটি গুটাইতে লাগিল সে।
অন্ধকারে নামাজ-পড়া ভালো দেখায় না। দরিয়াবিবি আগেই একটি টিনের ডিপা জ্বালিয়াছিল চুলার নিকট। নামাজের পাটির দুর্দশা আলোয় স্পষ্ট দেখা যায়।
দরিয়াবিবি বলে, নূতন নামাজের পাটি আর কেনা হল না? সব কাজেই খোদাকে ফাঁকি।
হলো কই! মেলায় গেলাম। একটা পাটি দেড় টাকা চায়।
দরিয়াবিবির তর্ক শেষ হইয়া যায়। তবু সহজে সে দমে না।
ছেঁড়া পাটি। সেজদায় যাওয়ার সময় মাথায় ধুলো লাগুক। কপাল ক্ষওয়া দেখলে লোকে বলবে, খুব পরহেজগার (ধার্মিক)!
পাটি গুটানো শেষ করিয়া আজহার খাঁ মুখ খোলে, আল্লাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে আজহার খাঁ নামাজ পড়ে না। আমার পর-দাদা আলী আসজাদ খাঁর নাম সবাই জানে। সেই বংশের ছেলে আমি।
পর-দাদা লেখাপড়া-জানা মৌলবী মানুষ। আমার আর লেখাপড়ার দরকার আছে? দরিয়াবিবি টিপ্পনী কাটিল।
আজহার খাঁ বংশের খোঁটা সহ্য করিতে পারে না। নিরীহ ভালো মানুষটি থাকে না তখন আজহার খাঁ। আপাতত চুপ করিয়া গেল সে।
তুমিও তো ঐ পাটিতে নামাজ পড়ো! তোমারও পরহেজগার হওয়ার শখ আছে।
তা আছে বৈকি! তোমাদের পায়ের তলায় আমাদের বেহেশত। তুমি যদি ঐ পাটি ব্যবহার কর, আমার জন্য বুঝি তা খুব দোষের ব্যাপার?
আজহার খাঁ এই মুহূর্তের জন্য অন্তত উষ্মা প্রকাশ করে। আর কোনো জিনিস চেয়ো না। পাটি একটা, যত দামই হোক কিনে আনব।
অত রাগের কাজ নেই। নামাজের পাটিতে কপাল ক্ষয়ে গেল, একটা পাটি কেনার আওকাত (সঙ্গতি) আল্লা দিল কৈ?
আজহার খাঁ চুপ করিয়া থাকে। দরিয়াবিবির কথা তাহার বুকের ভিতর তোলপাড় তুলে। এমন নাফরমান (অবাধ্য) বান্দা সাজিতেছে সে দিন-দিন। তৌবাস্তাগুফের পড়িল আজহার খাঁ তিনবার। তারপর গুম হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
ছেলেদের দিকে দেখো, আমি ঘাট থেকে আসি।
দরিয়াবিবি চলিয়া গেল। সারাদিনের পর অবকাশ মিলিয়াছে। চৈত্রের বাতাস বহিতেছিল ঝিরিঝিরি। বস্তার নিচে আগাছা-জঙ্গলে নামহীন কুসুম ফুটিয়াছে কোথাও।
খুব তাড়াতাড়ি দরিয়াবিবি পুকুরঘাট হইতে ফিরিয়া আসিল।
আজহার ছেলেদের লইয়া উঠানে বসিয়াছিল। জিজ্ঞাসা করে সে, এত তাড়াতাড়ি এলে?
দরিয়াবিবির অবয়বে ব্যস্ততার ছাপ।
বকরিটার বাচ্চা হবে বোধ হয়। ভারি ভ্যাবাচ্ছে, রাত বেশি হয় নি। ঘরে এনে–
না, না দেরী আছে।
আশঙ্কিত দরিয়াবিবি বলে, না, থেকে-থেকে ভারি ভ্যাবাচ্ছে। রাত্রে যদি বাচ্চা হয়, যা উঁদে বাছুর রয়েছে, লাথিয়ে মেরে ফেলবে কচি বাচ্চা।
বাড়ি-সংলগ্ন ছোট উদ্বাস্তু। তারপর পুকুর আর পুকুরঘাট। পশ্চিম-উত্তর কোণে গোয়ালঘর। গরু-বাছুর-ছাগল একই জায়গায় রাখা হয়। পাড়ের দুপাশে বুনো ঘাস। সাপের আড্ডা। আজহার খর তাই কাজের কোনো চাড় ছিল না।
দরিয়াবিবি বাক্যালাপ না করিয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিল। ব্যঞ্জনাদি পেয়ালায় পরিবেশনের সময় সে উৎকর্ণ হইয়া রহিল। ছাগলের ডাক ঘন ঘন শোনা যাইতেছে।
এবার ছেলেদের নিয়ে এসো।
ডাক দিল দরিয়াবিবি। কণ্ঠস্বরে ক্রোধ চাপা রহিয়াছে।
নঈমা নিজের হাতে খায় না। দরিয়াবিবি সকলের খাবার দেওয়ার পর তাকে কোলে তুলিয়া লইল। তার ঘুম যেন সম্পূর্ণ ভাঙে নাই। মার আঙুলের অন্ন সে নিঃশব্দে খাইতে লাগিল।
দরিয়াবিবির কান সদাসর্বদা খাড়া রহিয়াছে। ছাগলের চিৎকার মুহূর্তে শোনা যায়। অভাব-ছোঁওয়া সংসারে এই মূক পশুরাই তাহাদের সম্বল। গত বছর গোয়ালঘরে ছাগলের বাচ্চা হইয়াছিল। দুটিই গরুর গুঁতোয় মরিয়া যায়। তার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে। সেই ছানা দুটি থাকিলে এই বছর চড়া দামে বিক্রি হইত! ব্যাপারীরা সেদিনও খোঁজ লইয়াছিল।
খাওয়াদাওয়া চুকিয়া গেলেও দরিয়াবিবির অবসর অত সহজে আসে না। আকাশে মেঘ জমিয়াছে। ভোররাত্রে যদি বৃষ্টি নামে! উঠানের পশ্চিমকোণে ঘুঁটে মেলা আছে। আজ ভিজিয়া গেলে কাল আর চুলা জ্বলিবে না! গাছের ঝরাপাতা লইয়া পাড়ায় মেয়েদের কোন্দল বাঁধে। দরিয়াবিবি ঝোড়ায় খুঁটেগুলি তুলিবার জন্য ছুটিয়া গেল। হাত-পা ধুইয়া আসিয়াছিল, আবার ঘুঁটে ছুঁইতে হইল। দরিয়াবিবি সহজে পরিশ্রান্ত হয় না। তবু আজ খারাপ লাগে তার।
আমজাদ মার কাছে শোয় না। তার আসর অন্য ঘরে। আজহার খাঁর দূর-সম্পর্কীয় এক বুড়ি খালা আছে। আসেকজান। সে চোখে ভালো দেখে না, শ্রবণ-শক্তিহীন। তার আর কোনো আশ্রয় নাই। এখানেই কোনোরূপে মাথা খুঁজিয়া থাকে। ঈদ, মোহররম ও অন্যান্য পর্বের সময় গ্রামের অবস্থাপন্ন মুসলমানেরা খয়রাত করে, জাকাত দেয়– তারই আয়ে কোনো রকমে দিন চলে। সন্ধ্যার পূর্বেই সে ঘরে ঢুকে, আর বাহির হয় না। খাওয়ারও কোনো হাঙ্গামা নাই তার। আমজাদ তার পাশে ঘুপটি মারিয়া শুইয়া থাকে।