আমু, বাছুর খুঁজতে তুমি কতদূর গিয়েছিলে?
মাঠের দিকে গিয়ে কত ডাকলুম। কবরস্থানের কাছে–
দরিয়াবিবি একটি হাঁড়ি নামাইয়া রান্নাঘরের দিকে গেল। উঠানের পশ্চিমদিকে দুখানি খড়োঘর। ছিটেবেড়ার তৈরি। শোয়া-বসা চলে দুই ঘরে। পাশে রান্নাঘর।
হাঁড়িকুড়ি তৈজসপত্র এইখানে থাকে।
রান্নাঘরে হাঁড়ি রাখিয়া দরিয়াবিবি ফিরিয়া আসিল।
তুই গিয়েছিলি পুরানো কবরস্থানের দিকে?
শহীদি কবরগাহের নাম পুরাতন কবরস্থান। হাল-আমলের অন্য গোরস্থান আছে।
বারবার মানা করব, আমার কথা তো শুনবি নে।
আমার ভয় লাগেনি তো, মা।
নেই লাগুক। দাঁড়া, একটু বড়পীরের পানি-পড়া আনি। দরিয়াবিবি একটি বোতল ও মাটির পেয়ালা সঙ্গে আনল।
আজহার খাঁ অন্ধকারে ঝিমাইতেছিল। শরীর খুব ভালো নয় তার। এতক্ষণ সে মাতাপুত্রের গতিবিধির দিকে লক্ষ্য রাখে নাই।
কী আনলে, দরিয়া-বৌ।
বড়পীরের পানি-পড়া, একটু ছেলেটাকে খাওয়াব।
আজহার খাঁ তীরবেগে ছুটিয়া আসিল তাহাদের নিকট।
কর কী, দরিয়া-বৌ। এসব কি?
কেন কী হয়েছে?
এসব কী! পানি-পড়া খাওয়াচ্ছ? ওহাবীর ঘরে এসব বেদাৎ। লোকে কী বলবে?
দরিয়াবিবি বাজখাঁই গলায় বলে, বসো। তোমার বেদাৎ (শাস্ত্রনিষিদ্ধ) তোমার কাছে থাক।
ভালো কথা নয়, দরিয়া-বৌ।
আজহার শান্তস্বরেই জবাব দিল।
এসব নিয়ে কেন গোলমাল বাধাও? ছেলেদের রোগ-দেড়ী আছে। আমি খাচ্ছি। নাকি?
দরিয়াবিবির হাতের কামাই নাই। পেয়ালার পানিতে এতক্ষণ আমজাদের কণ্ঠ ভিজিয়া গেল।
আজহার খাঁ সাধারণত বেশি কথা বলে না। সে গুম হইয়া খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল।
দরিয়াবিবির উপর কোনো কথা চলে না।
আজহার আবার হুঁকা হাতে নিজের জায়গায় ফিরিয়া গেল।
দরিয়াবিবি অনুভব করে, স্বামী রাগান্বিত। পরিবেশ আবার স্বাভাবিক করা দরকার। আমজাদকে বলে, তোর আব্বার কাছে গিয়ে একটু গল্প কর। চুলোর আঁচটা দেখি।
আমজাদ ইতস্তত করে।
গুড়ুক টানার আওয়াজ হইতেছিল। আজহার খাঁ নিস্তব্ধ। আমজাদ পিতার নিকট গিয়া ধূলার উপর বসিল।
আজহার খাঁ এইবার কথা বলে, ধুলোয় বসলি আমু? আয়, আমার কোলে বস।
দরিয়াবিবি চুলোর নিকট হইতে জবাব দেয় : আমিও যাব নাকি?
এসো না, আম্মা।
আজহার খাঁ পুত্রকে কোলে বসাইয়া গুড়ুক টানে।
থাক বাবা, আমার গিয়ে দরকার নেই।
আজহার খাঁ দেখিতে পাইল, দরিয়াবিবি তরকারি নুন চাখিবার জন্য হাতের তালু। পাতিয়াছে। মুখে পুঞ্জ হাসি রেখায়িত।
চুলার আগুন নিভিয়া আসিতেছে। রান্না প্রায় শেষ। দরিয়াবিবির মুখ আর চোখে পড়ে না। কানে তার হাসি ভাসিয়া আসে।
সারাদিন খেটেপুটে চুপচাপ সবাই। দুঃখ তত চিরকাল। ছেলেটাকে নিয়ে একটু গল্প করো না।
আজহার খাঁ মাঝে মাঝে অতীতের বংশ-কাহিনীর কথকতায় মত্ত হয়। সব দিন নয়। আজ সে কোনো জবাবই দিল না। নিঃশব্দে তামাক সেবন করিতেছিল, তার কোনো ব্যতিক্রম দেখা গেল না।
সারা উঠানময় নিস্তব্ধতা। পুত্র পিতার কোলে আসীন। মা হাঁড়ি লইয়া ব্যস্ত।
চুলা প্রায় নিভিয়া গিয়াছিল। সামান্য কাজ বাকি আছে। দরিয়াবিবি আবার একরাশ পাতা আনিয়া চুলার মুখে জড়ো করিল।
অশথের কাঁচা পাতা সহজে ধরে না। ধোঁয়ায় উঠান ভরিয়া গেল। বাঁশের চোঙা দিয়া দরিয়াবিবি ফুঁ দিতে থাকে। একটু পরে চুলা জ্বলিতে লাগিল। পাছে আবার নিভিয়া যায়, নিঃশঙ্ক হওয়ার জন্য দরিয়াবিবি আরো পাতাপুতি খুঁজিয়া দিল। দাউদাউ শিখা আবার উঠানের চারিদিকে তার আলো ছড়ায়।
প্রাঙ্গণের উপর একটা অতর্কিত ছায়া পড়িল। ছায়ার কায়া দেখা গেল কয়েক মুহূর্ত পর। একটা তিন বছরের উলঙ্গ মেয়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতেছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। চোখে পিঁচুটিভরা। সে ভালোরূপে চোখ মেলিতে পারিতেছে না। অভ্যাসের সাহায্যে চেনা উঠানের খবরদারি করিতে বাহির হইয়াছে যেন।
তার উপর প্রথম দৃষ্টি পড়িল আজহার খাঁর।
আয় মা, আয়। এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
সকলের নজর পড়ে মেয়েটির উপর।
আমজাদ চিৎকার করে : ঐ ভূত-বুড়ি এসেছে।
দরিয়াবিবি পিছন ফিরিয়া হাসিয়া উঠিল : বুড়ি, এতক্ষণে ঘুম ভাঙল?
আজহার খাঁ ডাকে, নঈমা এদিকে আয়।
দরিয়াবিবির ছোটমেয়ে নঈমা। সন্ধ্যার সময় কাজের ঝামেলা থাকে। বড় বিরক্ত করে তখন সে। কান্না জুড়িয়া দেয় রীতিমতো। আজ বিকালে তাকে ঘুম পাড়াইয়াছিল দরিয়াবিবি নিজে।
নঈমা আজহার খাঁর নিকট গেল না। সোজাসুজি মার নিকট আসিয়া দাঁড়াইল।
একটু দাঁড়া, মা।
দরিয়াবিবি একটি হাঁড়ি চুলার উপর হইতে নামাইয়া নঈমাকে কোলে বসাইল, আঁচলের খুঁট দিয়া চোখের পিঁচুটি মুছাইয়া দিল।
কোনো কথা বলে না নঈমা। হাই উঠে তার ঘুম যেন গা-মতো হয় নাই।
কি রে, আরো ঘুমোবি, মা?
নঈমা কথা বলে না। মার বুকে মুখ গুঁজিয়া সে আরাম পায়।
আর একটু সবুর কর, মা! তারপর তোর আব্বাকে ভাত দেব, তোর আমু-ভাই খাবে, তুই খাবি।
ভাতের কথায় নঈমা উশখুশ করে মার কোলে।
এশার নামাজ তবে পড়ে এসো। আর দেরি করে লাভ নেই, নঈমার চোখে এখনও নিদ রয়েছে।
আজহার খাঁকে লক্ষ্য করিয়া দরিয়াবিবির উচ্চারণ।
স্বামী জবাব দিল, এদিকে আমুরও ঘুম পেয়েছে। আমার কোলে শুয়ে বেশ নাক ডাকাচ্ছে।
বিড়ার উপর বসিয়া আমু ঢুলিতে থাকে। দুই চোখ ভরিয়া গোটা রাজ্যের ঘুম আসিয়াছে।
দরিয়াবিবি এক বা পানি আনিয়া দিল।