কঞ্চির ঝুড়ির ভিতর আজহার কুঁচানো খড় রাখিতেছিল। প্রায় পূর্ণ ঝুড়িটি দমকা। বাতাসে হঠাৎ আড় হইয়া গেল। কুঁচো খড় হাওয়ায় উড়িতে থাকে। আজহার বঁটি ছাড়িয়া বলে, আমু, ধর বাবা ধর।
আমজাদের কচি মুঠি নাগাল পায় না। দরিয়াবিবি স্বামীর সাহায্যে অগ্রসর হয়। তার বয়স তিরিশের কাছাকাছি। দোহারা বাঁধন শরীরের। গোলগাল মুখটি গাম্ভীর্যে টইটুম্বুর।
আমজাদ কুঁচো খড়ের পিছনে এদিক-ওদিক দৌড়ায়।
ঐ দ্যাখো আব্বা, উড়ে যাচ্ছে।
খড়কুটো বাতাসের বেগে উপরে উঠতে থাকে।
দরিয়াবিবি ভারী শ্রান্ত হইয়া বলে, কী ছিরি তোমার কাজের।
দরিয়াবিবি স্বামীর দিকে তাকায়।
আজহার শান্তকণ্ঠে জবাব দিল, আচমকা হয়ে গেল। আর কোনোদিন এমনটা হয়েছে?
বাতাসে দরিয়াবিবির চুল এলোমেলো, হঠাৎ একমুঠো খড় হাতে সে ডাকে, আমু, এদিকে আয় তো বাবা, আমার চোখ কী পড়েছে দ্যাখ।
দরিয়াবিবি ততক্ষণ বসিয়া পড়িয়াছে। আমজাদ মার কাছে ছুটিয়া যায়।
এই খড়গুলো ঝুড়ির ভিতর রেখে আয়।
আমজাদ এক মিনিটে মার আদেশ পালন করিল।
ভারি করকর করছে চোখটা।
দরিয়াবিবি কাপড়ের খুঁটে মুখের ভাপ দিতে থাকে।
ভালো হল, মা?
দাঁড়া বাবা, খামাখা বকাসনি।
আমজাদ ফালি লুঙি পরিয়াছিল। মার দেখাদেখি সে-ও লুঙির খোঁট মুখের ভিতর ঢুকায়।
তরকারিটা বুঝি পুড়ে গেল!
দরিয়াবিবি এবার লাফ দিয়া চুলার কাছে পৌঁছাইল।
আমু, একটু পানি দে, বাবা।
আমজাদের সাহায্য চাওয়া বাতুলতা।
দরিয়াবিবি দৌড়িয়া ঘরের দিকে ছোটে। কলস তো সেখানেই।
এক মালসা পানি হাঁড়ির মধ্যে ঢালিতে ঢালিতে বলে, বাপবেটায় এক হুজুগ নিয়ে এলো। চোখটা এখনও করকর করছে।
আজহার একটি খড়ের বিড়ার উপর বসিয়াছিল। হাতে নারকেলি হুকা।
দরিয়াবিবি, চুলোতে আগুন পড়েছে?
চুলোর মুখে বসিয়া দরিয়াবিবি এলোচুল বিন্যস্ত করিতেছিল।
আগুন পড়বে না? কত সিঁদরে কাঠ জ্বালাচ্ছি।
আজহার দরিয়াবিবির দিকে তাকায়। তার ফরসা রং মুখে এখনও শ্রান্তির ছায়া আঁকা। স্বামীর উৎসাহ নিভিয়া আসে। ককেটা আজহার খাঁমোখা মাটির উপর ঘুরাইতে থাকে।
তুমি জানো, পাতার আগুন। এতে আবার ভালো আগুন পড়ে? কাঠ-পোড়ানো। নসিবে লিখেছে আল্লা?
ঐ আগুন-ই দাও।
তা দিচ্ছি। পাতা ঝেটোনোরও হাঙ্গামা কত। ও-পাড়ার সাকেরের মা বলে, আমাদের গাছের পাতা আর ঝেটিয়ো না, খায়ের বৌ। (পরে ঈষৎ থামিয়া) খড় সব বেচে দিলে?
আজহার ভারি তামাক খায়। তার নেশা চটার উপক্রম, আর ধৈর্য থাকে না, নিজেই কলকে হাতে দরিয়াবিবির সম্মুখে দাঁড়াইল।
খড় না বেচলে, খাজনা দেওয়া হল কোথা থেকে?
বেশ, ভালোই করেছ। থাকলে গরু-বাছুর খেয়ে বাঁচত। পোয়ালটা পুড়ানো চলত। যা জ্বালানির কষ্ট।
স্বামীর দিকে চাহিয়া দরিয়াবিবি ঘোমটা টানে। এতক্ষণ খেয়াল ছিল না। নিঃশব্দেই সে আজহারের হাত হইতে কলকে গ্রহণ করিল।
বাবা আমু, একটা খাপরা নিয়ে এসো।
আজহার জিজ্ঞাসা করে, খাপরা কী হবে?
ভারি মোলায়েম কণ্ঠ এবার দরিয়াবিবির। –বাতাসে ফিকি ছুটলে আর রক্ষে আছে! আগুন লেগে যাবে।
সাবধানে কলকের মুখে আগুন দেয়ার পর দরিয়াবিবি খারাটা উপরে চাপ দিয়া বসাইল।
যা দমকা বাতাস, গাছের পাতাপুতি আর ওসুল হবে না। চুলোর হাঙ্গামা পোয়াতেই অস্থির।
ফুড়ুক-ফুড়ুক শব্দ হয়। চক্ষু বুজিয়া আজহার হুঁকা টানে।
দরিয়া-বৌ, পুকুরপাড়ে কটা গাছ আছে, কাটালে হয় না? কয়েক মাসের জ্বালানোর জন্যে আর ভাবতে হয় না।
না, ওসব কাটলে, তারপর? কোনো কাজকর্ম নেই আর? ছেলেদের বিয়েশাদি নেই?
আমজাদ মার পাশে বসিয়াছিল। সে বলে, কার বিয়ে হবে, মা?
আমার। বলিয়া দরিয়াবিবি মৃদু হাসে। গম্ভীর মুখাবয়বে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলিয়া যায়।
পরে সে আজহারের দিকে চাহিয়া বলে, ছেলেটা কোনো কথা বলতে দেবে না। ঘরকন্নার কথার সময় কিছু ভালো লাগে না।
তোর আব্বার বিয়ে হবে, আমু।
আজহার নিঃশব্দে তামাক খায়। কয়েক বিঘা জমি। সে আজ নিজেই হাল করিয়াছে। দরিয়াবিবির কথা তার কাছে পৌঁছায় না। তন্দ্রায় নেশা জমিতেছিল তার তামাকের ধোঁয়ায়।
সুপ্তোত্থিতের মতো সে বলে, কার বিয়ে দিচ্ছ?
তোমার, আমার, গোটা গাঁয়ের।
দরিয়াবিবি হাসে। আজহার তার মুখের দিকে একবার তাকাইল মাত্র। আবার গুড়ুক টানার শব্দ হয় উঠানে। আজহার খাঁ স্বভাবতই নিরীহ। দৈনন্দিনতার সংগ্রাম ছাড়া আর কিছু তাকে সহজে স্পর্শ করে না।
দরিয়াবিবি পার্শ্বে উপবিষ্ট পুত্রকে বলে, তোর বাবাকে ডাক্। জেগে আছে তো?
বাবাজি!
আজহার জবাব দেয়, কী আমু?
দরিয়াবিবি স্বামীকে অনুরোধ করে, এখনি রান্না শেষ হবে। আমুর সাথে গল্প করো।
মা!
কি রে!
দ্যাখ না গোয়ালঘরে, বাছুরটা এসেছে তো!
ভারি মনে করি দিলি, বাপধন! ওগো বাছুরটা দেখো না।
আজহার খাঁ বাছুরের জন্য কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে না।
দেখো, কাল সকালে ঠিক আসবে।
আমজাদ দরিয়াবিবিকে চুপিচুপি বলে, এখন গোয়ালে দেখে আসতে বলো না।
এখন যাও না একবার গোয়ালডাঙায়।
থাক আজ।
শাদা বাছুর। আমজাদের ভারি প্রিয়। মার কাছে ফরিয়াদের আর অন্য কোনো কারণ নাই।
মা, বাছুরটাকে যদি শেয়ালে ধরে।
অতবড় বাছুর আবার শেয়ালে ছুঁতে পারে? আজহার খাঁ আবার সন্দেহ প্রকাশ করে।
আজকালের শেয়াল।
আজকালের শেয়াল তো একবার যাও না। কৃত্রিম রাগান্বিত হয় দরিয়াবিবি।