হঠাৎ চাচির খন্খনে গলার আওয়াজ শোনা যায়। ঘুলি-পথের উপর উৎকর্ণ আজহার থমকিয়া দাঁড়াইল। হ্যাঁ, চাচিরই গলার আওয়াজ বটে, দূর হইতেও স্পষ্ট বোঝা যায়।
হারামজাদী, ঘরে টাকাপয়সা নেই, সে বাড়ি থাকতে বললি নে কেন? মুখের হ্যাঁদা বুজে গেছে বুঝি?
আরো গালিগালাজের অগ্ন্যুৎপাত। চাচি আদৌ বৌকে দেখিতে পারে না, আজহার জানে। কিন্তু আজ সেজন্য বিশেষ মাথাব্যথা নাই তার। সাকেরের ঘরেও টাকা নেই। বুকটা দমিয়া গেল আজহার খাঁর। চাচিকে শান্ত করিতে সে আর একবার ফিরিয়া আসিত, সে উৎসাহও ধীরে ধীরে নিভিয়া গেল।
গোয়ালঘরে সামান্য কাজ বাকি ছিল। আজহার খাঁ আজ যন্ত্রচালিতের মতো তাহা সম্পন্ন করিল। চন্দ্র কোটালের কাছে একবার খবর দেওয়া দরকার। সে আশায় আশায় থাকিবে। পাড়ার আর কারো কাছে হাত পাতা নিরর্থক। গফুর খাঁর গঞ্জের দোকান দিন দিন ফাঁপিয়া উঠিতেছে। তার পুরাতন ঋণ দুই বছরে শোধ হয় নাই। সে পথও রুদ্ধ। আরো কয়েকজন সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিবেশীর কথা মনে পড়িল আজহার খাঁর। কিন্তু চারিদিকে খটকা।
দরিয়াবিবি পূর্বতন শ্বশুরবাড়ির দুইটি দুল আনিয়াছিল। গত বৎসর আমজাদ ও নঈমার অসুখে তা-ও পোদ্দারের দোকানে বাঁধা পড়িয়াছে।
চন্দ্র হুঁশিয়ার লোক। ব্যবসায় কপাল-খোলা বিচিত্র নয়। কিন্তু রুদ্ধ অদৃষ্টের কপাট খুলিতে সামান্য কুঞ্জিকার কথা, আজহার ভাবিতে পারে না।
মাঠের পথে চিন্তা-ভারাক্রান্ত মনে সে উপায়ের কল্পনা করিতে লাগিল। হঠাৎ আকাশে মেঘ জমিয়াছে। সূর্যের আলো পলাতক। বর্ষাকাল, যে-কোনো সময় বৃষ্টি নামিতে পারে। এই মনে করিয়া আজ গরু মাঠে ছাড়িয়া দেয় নাই আজহার।
সে কোটালের বাড়ির কাছাকাছি আসিয়াছে এমন সময় দমকা বৃষ্টি নামিল। দুপুরে গোসল করিতে হইবে, তাই বৃষ্টির কোনো তোয়াক্কা রাখে না আজহার। সোজাসুজি সে গাঙের ধারে আসিয়া থামিল। চতুর্দশীর জোয়ারের সময় চন্দ্র ঘরে থাকার বান্দা নয়। তা ছাড়া মাছ ধরা একটা নেশা কোটালের।
খালের দুই ধারে ঝাপসা গাছপালা। ঝমঝম বৃষ্টি ঝরিতেছে। কোনো জনপ্রাণী চোখে পড়ে না। সকলেই বোধহয় আশ্রয়ে ঢুকিয়াছে। বামে ডিঙি নড়ার ঠকঠক শব্দ শোনা গেল। উৎফুল্ল হইয়া ওঠে আজহার। চন্দ্র ছোট্ট পিনিসের উপর দাঁড়াইয়া জাল গুটাইতেছে। নৌকার গলুই একটি বাঁশের সঙ্গে বাঁধা। স্রোতের টানে বাঁশ ও কাঠের সমবায়ে একরূপ ঘর্ষণধ্বনি বৃষ্টির আওয়াজকে ছাপাইয়া উঠিতেছে।
আজহার হাঁকিল, চন্দর!
খালের দুই পাড়ে তার প্রতিধ্বনি ছড়াইয়া পড়ে।
সামান্য বৃষ্টির প্রকোপ মন্দীভূত। মেঘ হুড়ম-হুঁড়ম করিতেছে।
বোধহয় হাঁক চন্দ্র শুনিতে পায় নাই। আজহার নিজেই তার কাছে আগাইয়া আসিল। লম্বা বেড়াজালে জোয়ারের পূর্বে খালের মুখ ঘিরিয়াছিল চন্দ্র। ভাটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার জাল গুটাইতেছে। বড় শান্ত সে। দুই বাহুর পেশি স্পষ্ট ফুলিয়া উঠিয়াছে। তার দৃষ্টি শুধু জালের দিকে।
চন্দ্র চোখ না তুলিয়াই বলিল, খাঁ ভাই, একটু দাঁড়াও।
জাল গুটানো সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আফসোস করে, না ভাই, মজুরি পোষাল না। অনেকক্ষণ খাটছি।
মাত্র সের দুই মাছ পড়িয়াছে। দশ-বারোটি তপসে মাছ কেবল চন্দ্রের চোখে আনন্দের প্রলেপ টানিয়া যায়।
ভাবছিলাম, খিয়ে জাল দিয়ে আর একটু চেষ্টা করা যাক। না, তুমি এসেছ ভালোই হল।
দুজনেই বাড়ি অভিমুখী। চন্দ্র শীতে কাঁপিতেছিল। অনেকক্ষণ সে বৃষ্টির পানিতে ভিজিয়াছে। কোটাল-পুত্র তাই নির্বাক। মাছভরা খালুই হাতে দ্রুত হাঁটিতেছিল সে।
পা চালাও, খাঁ। একটান তামাক না টানলে আর নয়। জননী-৫
পিছল পথে সাবধানে পা ফেলে আজহার। বৃষ্টি এখনও সম্পূর্ণ থামে নাই। পাখির পাখনা-ঝাড়া ধোঁয়ার মতো ইলশেগুঁড়ি আকাশ হইতে ঝরিতেছে।
উঠানে হাঁকাহাঁকি করে চন্দ্র : সাজো, সাজো।
হাসিমুখে এলোকেশী ও চন্দ্রমণি বাহির হইয়া আসে।
দাদা যেন যুদ্ধের হাঁক ছাড়ছে।
এলোকেশী বোঝে, কী সাজিবার হুকুম কোটাল রাজার। সে আর দাঁড়ায় না, দাওয়ায় চন্দ্রমণিকে একটি আসন আগাইয়া দেওয়ার হুকুম দিয়া সে চলিয়া গেল।
এই চন্দ্রমণি! আজহার অবাক হইয়া যায়। মাঠে আসিয়া সে বহুদিন চন্দ্রের এই সহোদরাকে দেখিয়াছে। পাতলা চেহারার গঠন, ফরসা রঙ, বয়সে সে চন্দ্রের অনেক ছোট। অগ্রজই বহু চেষ্টা করিয়া তার বিবাহ দিয়াছে। কিন্তু এ কী ছিরি হইয়াছে তার। পাটকাঠি বা পাকাটির মানবিক সংস্করণ যেন গায়ে নাজেল হইয়াছে।
আমার কাপড়চোপড় ভিজে গেছে মণি, খড়ের বিড়েটা আর নষ্ট করব না। এমনি বসছি। কিন্তু তুই এমন হয়ে গেছিস্ কেন?
কপাল ভাঙলে আর কার গতর ভালো থাকে, দাদা!
আজহার চুপ করিয়া গেল। পঁচিশ পার হয় নাই, ওই কচি মেয়েটা আল্লার কাছে কী গোনাহ্ করিয়াছিল, যার শাস্তি এমন নির্মম! আজহার এদিকে ধর্মপ্রাণ বুদ্ধি দিয়া যার নাগাল পায় না, সেখানে আল্লার মক্করের সন্ধান সে সহজেই লাভ করে।
জ্বর হয় তোর, মণি?
আজহারও মুষড়াইয়া যায়। আল্লার বান্দার বেশিরভাগ এই একই দশায় উপনীত! গাঁয়ের দশটা ঘর খুঁজিয়া পাওয়া মুশকিল, অভাব-অনটনপ্রসূত কোনো ঝঞ্ঝাট যেখানে অনুপস্থিত।
ম্যালেরিয়া জ্বরে দুমাস ভুগছি। তবে শরীর আগে থেকেই খারাপ।