আমজাদ এতক্ষণ দুইজনের কথোপকথন শুনতেছিল, সেও কোনো কথা বলিতে সাহস করে না।
হঠাৎ উঠিয়া পড়িল চন্দ্র। সে বলে : আমার অনুরোধটা ভেবে দেখো, খা ভাই। বেলা হয়ে গেল, যাই–
নিরাশাক্ষুব্ধ কণ্ঠ চন্দ্র কোটালের। আজহার বহুদিন এমন দীনতা দেখে নাই তার। কোনো জবাব দিল না সে।
আজহার নীরবে দাঁড়াইয়াছিল। চন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া টান দিল, একটু এগিয়ে দাও, চাচা।
গাঁয়ের সরুপথে ডোবার উপর বহু শাপলা ফুটিয়াছিল। চন্দ্র কয়েকটি আমজাদের হাতে তুলিয়া বলিল, এবার বাড়ি যাও, ভারি রোদ্দুর উঠেছে।
আমজাদ বাড়ির পথ ধরিল। মাঠের সড়কে অগ্রসর হইতেছে চন্দ্র। তার শিসের শব্দে আমজাদ মুখ ফিরাইয়া দেখিল, হেলিয়া-দুলিয়া মন্থর চালে চন্দ্র হাঁটিতেছে। বোধহয় ফুর্তিতেই শিস দিতেছে। পৃথিবীতে যেন কোনো কিছু ঘটে নাই।
০৬-১০. আজহার প্রতিবেশী সাকের
সকালে আজহার প্রতিবেশী সাকেরের খোঁজ লইতে গেল।
পাশের পাড়া। ভিটা ছাড়িয়া সামান্য কলাবাগান হইতে বেশি সময় লাগে না। আজহার ভাবিতেছিল, সাকেরের কাছে টাকা আছে। সে পেশাদার লাঠিয়াল। খা বংশের মহিমা বরং একমাত্র সে বজায় রাখিয়াছে। চোয়াড়ে প্রকৃতির চেহারা সাকেরের। লম্বা ঘন গোঁপের উপর ভাটার মতো দুই চক্ষু শিশুর আতঙ্কের পক্ষে যথেষ্ট। এই সময় তার কাছে টাকা থাকা সম্ভব। মাত্র দুইদিন আগে রোহিণী চৌধুরীর কোনো তালুকে প্রজা ঠেঙাইতে গিয়াছিল সে। জমিদারদের কল্যাণে তার অবস্থা অন্যান্য প্রতিবেশী অপেক্ষা ভালো। দাঙ্গার জন্য আরো ভিন গায়ে তার ডাক পড়িত।
চোয়াড়ে হোক সাকের, কিন্তু আজহার খাঁর সম্মুখে সে ভারি বিনয়ী, খুব মোলায়েম কণ্ঠে কথা বলে। আজহারের ধারণা সাকের তাকে শ্রদ্ধা করে। কোনোদিন তার কাছে টাকা হাওলাত করিতে যায় নাই। মুখের কথা সে অবহেলা করিবে না সহজে। আর চন্দ্রও যেমন বেয়াড়া! তার সঙ্গে বন্ধুত্বের জুলুম সহ্য করিতে কোনো কষ্ট হয় না।
সাকের ঘরে ছিল না। তার মা আজহারকে দাওয়ায় মাদুর পাতিয়া বলিল, আমার পেটে এমন ডিংরে ছেলে জন্মল, বাবা। আর পারি নে। লাঠিখেলা কেন যে শিখেছিল। এক দণ্ড শান্তি নেই। ও দাঙ্গা করতে যাবে, আর এদিকে আমাদের শাশুড়ি-বৌয়ের পেটে ভাত সেঁধোবে না।
সাকের কোথা গেছে, চাচি?
কাল সন্ধ্যায় বেরিয়েছে আর দেখা নেই।
উদ্বিগ্ন আজহার প্রশ্ন করে, দাঙ্গায় যায়নি তো?
না। লাঠিটা ঘরে রয়েছে। ঐ বাঁধানো লাঠি ছাড়া সে বেরোয় না। কিন্তু কোথা যে গেল!
আজহার নীরব। নিরাশার আঘাতে বারবার চন্দ্রের মুখ তার মনে পড়িতে থাকে। চন্দ্রটা এমন–
সাকেরের মা সংসারের কথা জুড়িল।
ছেলেমানুষ বৌটা তেমনি হয়েছে। ভয়েই মরে। চাষবাস করে খেতে বল, নিজের মানুষকে হাত কর। তা না। খালি দিনরাত ছেলের জন্য কান্না। কাঁচা বয়েস। ছেলে হওয়ার সময় কি পার হয়ে গেছে, বাবা?
হঠাৎ সুপ্তোত্থিতের মতো আজহার জবাব দিল : না, আমাদের হাসুবৌর আর কত বা বয়েস। কুড়ি পেরোয়নি।
এখনই ছেলের জন্যে হাঁপাহাঁপি। দোয়া তাবিজ আমি কি কম করতে বাকি রেখেছি! তবে মাস দুই হল নিস্তার। কপালে যদি থাকে।
সব আল্লার মরজি, চাচি। তোমার আমার মতো গোনাগার বান্দা আর কী করতে পারে?
না বাবা, আল্লা মুখ তুলে চেয়েছে। তারপর চাচি জোর গলায় হাসিল।
জানো বাবা, অভাগীর বেটি বলে কী—
আজহার জিজ্ঞাসু নয়নে চাচির মুখের দিকে তাকাইল।
বৌমা বলে, ছেলের মুখ না দেখলে ওসব লোক আর সংসারী হবে না। ও জোয়ান হওয়া অব্দি ভয়ে ভয়ে সারা জনমটা গেল। কি দিন কি রাত, বেঁচে সুখ নেই বাবা।
আজহার চুপ করিয়া শোনে, কোনো মন্তব্য করে না। তার দৃষ্টি প্রাঙ্গণের উপর। হঠাৎ মুখ অন্যদিকে ফিরাইতে সে বাধ্য হইল। সাকেরের স্ত্রী ঘাট হতে কলস কাঁখে ফিরিতেছিল। ভাশুরকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি উঠানের লাউগাছের ঈষৎ আড়ালে আড়ঘোমটা টানিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
নিজকে বিব্রত মনে করে আজহার খাঁ। সত্যই বড় কাঁচাবয়স সাকেরের স্ত্রীর। মুখখানা ভারি করুণ মনে হয়। পূর্ণ যুবতী, তবু মুখের আদলে সজীবতা নাই। যৌবনের শ্যামস্পর্শ যেন ক্ষণেক উঁকি দিয়া বিদায় লইয়াছে।
উঠানে লাউগাছের মাচাঙ। সূর্যের আলো সেঁধোয় না, নিচে এমন ঘন লতার পরিবেশ। দুই-একটি লাউ ঝুলিতেছে মাথার উপর। গোড়ার দিকে দশ-বারোটি সর্পিল রেখার আলিঙ্গন মাটির বুকের সহিত। সাকেরের স্ত্রীর কাপড়ের কোনো কোনো অংশ দেখা যায়।
আজহার যেন কত বিপদে পড়িয়াছে। বেগানা আওরতের সম্মুখে এমনভাবে বসিয়া থাকা শোভন নয়। সে উঠি-উঠি করিতেছিল। কিন্তু সাকেরের মার কথা আর ফুরায় না।
দোয়া করো, বাবা। বৌমার নিয়েৎ পুরা করুক খোদা।
আল্লার দোয়া। বান্দার কথায় আর কী হয়? মাঠে কাজ আছে, চাচি। আজ আর বসতে পারব না।
উঠিয়া পড়িল আজহার।
আচ্ছা, এসো বাবা। দরিয়াবৌকে এদিকে আসতে বলো। বৌমার মাস দুই হল, দরিয়াবৌর সাথে কতগুলো কথা আছে।
সাকের বাড়ি ফিরলে আমাকে একবার খবর দিও।
দুইপাশে কঞ্চির বেড়া। এই পথে কলাগাছের ছায়ান্ধকার জমিয়া উঠিতেছে। সূর্য উঠিতেছে তেজে। চারিপাশের আলো প্রখরতায় অস্পষ্ট জায়গায় অন্ধকার আরো ঘন মনে হয়। আজহার খাঁর মন নানা সন্দেহে দোলে। সকালটা কোনো কাজে আসিল না।