এমন সময় আজহার আসিয়া উপস্থিত হইল।
চন্দ্র তামাক যুঁকিতেছিল চোখ বুজিয়া। আজহারকে সে দেখিতে পায় নাই।
আমজাদ আনন্দিত হইয়া ডাকে, ঐ আব্বা এল।
এসো, এসো, খাঁ সাহেব —
চন্দ্র আজ সম্মান দেখাইতে তৎপর। বিড়া ছাড়িয়া সে উঠিয়া পড়িয়াছে। আজহার খ হাসে।
কি চন্দর, হঠাৎ কী মনে করে?
কখন থেকে বসে আছি। ডুমুর ফুলের খোঁজ নেই।
আজহার চন্দ্রের নিকট হইতে কল্কে লইয়া টান দিতে লাগিল।
ঘরে বসে থাকলে চলে, ভাই? পেটের ধান্দায় সকাল থেকে থেকে ঘর-ছাড়া।
কোথা গিয়েছিলে, শুনি?
খাঁ সাহেব জমিদারদের বাড়ি। হাতেম বখশ খ একটা কবর তৈরি করাবে নিজের। কত ইট-চুন লাগবে–তাই ডেকেছিল।
ওটা কি মরবে নাকি শিগগির?
কোনো জমিদারের পেছনে এমন অসম্মানসূচক কথা আজহার পছন্দ করে না। একটু বিরক্ত হয় সে।
একটু খাতির রেখে কথা বলো। ওটা কী বলছ?
যেন কত অনুতপ্ত, তারই ব্যঙ্গ-অনুসৃত কণ্ঠে চন্দ্র বলে, হ্যাঁ, মুরুব্বি লোক, পঞ্চাশ ষাট বয়স, খাতির করবো বৈকি। সত্যি মরবে?
রাখো তোমার মশকরা। সবাই মরবে। আমি কি মরব না?
তুমিও তবে আগে থেকে কবর খুঁড়ে রাখো।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আজহার। সে সৌভাগ্য তার নাই।
বহুত টাকা খরচ করবে, ভাই। তিন দিকে ইট, একদিকে শাদা মার্বেল পাথর।
তা তো করবেই। আমাদের বেঁচে খরচ করতে প্রাণ যায়, ওরা মরেও আমাদের জন্য খরচের রাস্তা তৈরি করে রাখে।
আজহার খাঁর মাথায় এত প্যাঁচওয়ালা কথা সেঁধোয় না। নির্বোধের মতো সে বলে, প্রায় দুহাজার টাকা খরচ। তারপর আবার বাগান হবে চারিদিকে। সেও আর এক হাজার।
বিস্মিত হয় চন্দ্র। বিজ্ঞের মতো জবাব দিল সে : আমার মণখানেক কাষ্ঠ দরকার। ব্যাস। আর নদীর ধারে একটা দেশলাইয়ের কাঠি খরচ। যদি অপঘাতে মরি– তাও খরচ নেই। স্বজনদের মেহনত খরচ হবে খানিকটা।
বাজে কথা রাখো। কেমন মাছ ধরছ জোয়ারে?
সেইজন্যে তো এলাম। মাছ ধরে কী হবে। এবার বর্ষায় দেখবে খুব মাছ পড়বে। কিন্তু সব তো নিয়ে যাবে পাইকের। ওদের অবস্থা দেখো। আমরা মাছ ধরি, পেটে ভাত জোটে না, ওরা পাকা দালান তোলে।
কী করতে চাও?
জিজ্ঞাসু নয়নে চন্দের দিকে তাকায় আজহার।
কিছু পুঁজি দরকার, ভাই। তাহলে আমি নিজেই রেল ইস্টিশনে গিয়ে মাছ বেচে আসতাম। পাঁচ-সাত সের মাছ নিয়ে খরচ পোষায় না। আরো দশটা লোকের মাছ জড়ো করলে এক মণ দু-মণ মাছ নিয়ে বেশ লাভ পাওয়া যেত।
আজহারের মুখের উপর দিয়া কালো রেখা পড়ে।
পুঁজি–পুঁজির কথা বলছ? সেই তো মুশকিল।
বেশি টাকার দরকার নেই। পঞ্চাশ হোলেই চলে। তুমিও কিছু দাও, খা ভাই। ভাগে ব্যবসা করা যাক।
ভয়ানক উৎসাহিত চন্দ্র।
কয়েক মিনিট চুপচাপ বসিয়া রহিল আজহার। কোনো জবাব নাই তার মুখে।
কী খাঁ ভাই, কিছু বলছ না যে
একরূপ সন্দেহার্ত দৃষ্টি ফেলে চন্দ্র।
কি আর বলব! পঁচিশ-তিরিশটা টাকা থাকলে কি চুপ করে যাই? আমাদের অবস্থা দেখছ না? হাত জানে তো মুখ জানে না।
এইবার চন্দ্রও চুপ হইয়া যায়।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সে।
আমারও তো ঐ দশা।
আজহার কথার সূত্র সংক্ষিপ্ত করে হঠাৎ।
তোমার এই ঝোঁক ধরল কেন? চাষ করে, ফুরসৎ পেলে মাছ ধরে বেশ তো দিন কাটছিল।
তা আর হবার জো নেই। চাঁদমণি ফিরে এসেছে।
চন্দ্রমণি কোটালের কনিষ্ঠ সহোদরা।
তোমার এখানেই থাকবে নাকি?
আরে যা ভাবছ তা নয়। স্বামী মরে গেছে। তিনটি ছেলে কোলে।
আজহার ইহার বিন্দুবিসর্গ জানিত না। সহানুভূতিপূর্ণ দুইচোখে কারুণ্য ফুটিয়া ওঠে।
কী হয়েছিল?
জ্বর ও বিকার।
ও। আজহার ঐ সংক্ষিপ্ত শব্দ তুলিয়া চুপ করিল।
তাই ভাবছি। রোজগারের পথ তো দেখতে হবে। ঘরও একটা বেশি নেই যে, মাথা গুঁজে থাকব। আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখতে পার না? কটা টাকা হলে দুজনেরই ভাগ্যপরীক্ষে হয়।
কে ধার দেবে, তাই ভাবছি। এত টাকা বিশ্বাস করবে কি?
দেখো চেষ্টা করে। আমরা মাছ ধরি, পাইকেররা তা শহরে বেচে পয়সাওয়ালা। যত টাকাপয়সা কি শহরে গিয়ে জমেছে?
তাই তো দেখছি!
চন্দ্র মাথা দোলাইল : আমার কাছে একটা ধাঁধা মনে হয়। আমরা ফসল করছি, গতর পুড়িয়ে মাছ ধরব, সব সেরা জিনিস শহরে ছুটছে। আমাদের পয়সাও হয় না, ভালো খাবারও জোটে না।
এই প্রশ্নের জবাব হঠাৎ আজহার খাঁর মাথায় খেলে : শহর থেকে যে কাপড় আসে, আরো কত জিনিস আসে তা দেখছ না? গাঁয়ের ফসল যায় শহরে। শহরের জিনিস আসে গাঁয়ে।
তা তো বুঝলাম। কিন্তু তারা সুখে থাকে, আর আমাদের এই দশা কেন? আমরা কি মেহনত করি না? না গতর খাটাই না? আমরা যদি চাল না দিই, শহরের ব্যাটারা। খাবে কী?
আজহার উত্তেজিত চন্দ্রের দিকে চাহিয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, তুমি তাহলে ন্যাংটা থেকো।
ন্যাংটা থাকব কেন? গাঁয়ে তাঁতিরা কাপড় বুনবে।
সেদিন আর নেই ভায়া। ঐ তো কঘর তাঁতি আছে, তাদের কাপড় কেউ ছোঁয়? অবস্থা দেখছ না তাদের? সব কপালের ফের!
চন্দ্র চুপ করিয়া গেল। তার মাথায় স্টেশনের পাইকাররূপে মাছ-বিক্রেতা হওয়ার স্বপ্ন তখনও মুছিয়া যায় নাই।
শহরেই তো সব। গাঁয়ের জমিদারের চেয়ে ঐ ব্যবসাদারদেরই টাকা বেশি। তালেব চৌধুরী লোহার কারখানা করে দেখছ ফেঁপে যাচ্ছে। হাতেম খাঁকে দশবার কিনতে পারে।
আজহার সায় দিল মাথা দোলাইয়া, কোনো মন্তব্য করিল না।
দুইজনে নিস্তব্ধ। নীরবতার দুঃসহ শাসন কেউ যেন আর অবহেলা করে না।