মা।
এক হাত উঁচু করিয়া সে আবার চিৎকার করে, মা!
দরিয়াবিবির চোখে সূর্যের আলো পড়িয়াছিল। পুত্রের সর্বশরীর চোখে পড়ে না।
বাড়িটা যে মাথায় তুলে চেঁচাস। কি—
এই দেখো।
হাত তুলিয়া আমজাদ ধেই ধেই নৃত্য করে।
নিকটে পৌঁছানো মাত্র দরিয়াবিবি দেখিতে পায়, আমজাদের হাতে দশ-বারোটি বড় চিংড়ি মাছ। দাঁড়াগুলি তার মুঠোর মধ্যে। লাল সরু শুড় রৌদ্রে চকচক করিতেছে।
দরিয়াবিবির ঠোঁটেও হাসি উপচিয়া পড়ে।
কোথা পেলে, বাপ?
বলছি। বলিয়া আমজাদ এক লাফে দাওয়ার উপর উঠিল।
মাঠের চন্দ্ৰকাকা দিয়েছে। আমাদের মতবে গিয়েছিল। মৌলবী সাহেব তাইতো ছুটি দিলে।
বেশ বড় চিংড়ি রে!
একটা ডাগর চিংড়ি বাহির করিয়া আমজাদ বলিল, এইটা আমার, যা লাল মগজ আছে ভেতরে!
দরিয়াবিবির আর আনন্দ ধরে না। কচি শিশুদের মুখে খুব কম দিনই ভালো ব্যঞ্জন জোটে।
খালা, আজ তোমারও ভালোই হল। ভাবছিলাম, খাওয়ার কষ্ট হবে।
আসেকজান এতক্ষণ নির্বিকার ছিল।
কী বৌমা?
আমু চিংড়ি এনেছে। দুপুরে খাওয়াটা ভালোই হবে। মাঠের কোটালরা দিয়েছে।
আমজাদ মার হাতে মাছগুলি সোপর্দ করিয়া বলে, তাড়াতাড়ি পান আর চুন দাও, কাকা দহলিজে বসে আছে।
তবে এতক্ষণ বলিসনি?
দরিয়াবিবি তাড়াতাড়ি ঘরের দিকে ছোটে। অন্যদিকে আসেকজান আমুর সঙ্গে তখন ইতিবৃত্ত সংগ্রহ করে।
নিয়ে যা, বাবা। তোর কাকা তামাক খায়?
আরে বাব্বা তামাক খায় না? তামাক-ক্ষেত খেয়ে ফেলে।
দরিয়াবিবি আবার তামাক সংগ্রহে ছুট দিল।
দহলিজে একটি বিড়ার উপর চন্দ্র কোটাল বসিয়াছিল। হাতের কামাই নাই। গোটা পান, চুন, সুপারি দিয়াছিল দরিয়াবিবি, তাহাই সে সাজিয়া লইতেছিল।
চন্দ্র কোটাল একটি খাটো ধুতি পরিয়াছিল মাত্র। কোমরে কাস্তে গোঁজা রহিয়াছে। পান-সাজার সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ খুলিল।
তোমার বাপ কোথা, চাচা?
আজ তো কোথাও যায়নি। গাঁয়েই আছে। বোধহয় পাড়ার দিকে গেছে।
দেখা করতে এলাম। কথা ছিল।
একটু বসো না, কাকা।
চন্দ্র কোটাল চারিদিকে তাকাইল। আরো কয়েকবার সে খ-পাড়ায় আসিয়াছে। বর্ষাকালে নদীর ধার হইতেই মাছ বিক্রয় হইয়া যায়। কালেভদ্রে পাড়ায় আসিতে হয়।
নূতন লোক দেখা মেয়েদের সাধারণ কৌতূহল। দহলিজের খিড়কির দিকে ঘোমটার আবছায়া দেখিয়া চন্দ্র ঠিক অনুমান করিয়াছিল, আমজাদের মা আসিয়াছে।
মুখে পান খুঁজিয়া জোর গলায় বলে, চাচা, তোমার মা দুপুরবেলা খাওয়াবে?
আমজাদ বাড়ির ভিতর চলিয়া যাইতেছিল। দহলিজের পেছনেই দরিয়াবিবি দাঁড়াইয়াছিল, হাত-ইশারায় পুত্রকে আহ্বান করিল।
আমজাদ মার কাছে দাঁড়াইয়া জোরগলায় বলে, গরিব মানুষ, ডাল-ভাত আছে।
চন্দ্র হাসে। আরো জোর গলায় বলিল, আমরা রোজ ঘোড়ার মাথা খাই। ডাল-ভাত হলে চলবে না। রোজ রোজ অশ্বমেদ জগৃগি করে চন্দ্র কোটাল।
তারপর প্রাণ-মাতানো হাসি। মস্ত দহলিজ গুঞ্জরিত হয়।
চাচা, খাওয়ার আগে তোমার মাকে তামাক দিতে বলো। নেশা চটে গেল।
পাঁচ মিনিট পরে কল্কে আনিয়া দিল আমজাদ। কাঠকয়লায় বোঝাই। আমজাদের কচি হাতে উত্তাপ লাগে।
শিগগির আমার হাতে দাও।
চন্দ্র দুই তালুর মাঝখানে কল্কে চাপিয়া তারপর দম দিতে থাকে। দুই চক্ষু বুজিয়া আসে নেশায়।
আমজাদ বিস্ময়ে এই লোকটির দিকে বারবার তাকায়। অতিকষ্টে হাসি চাপিয়া রাখিতে হয়।
একটু পরে চক্ষু খুলিল কোটাল।
দহলিজের সম্মুখে দুইটি নিমগাছ বাতাসে দুলিতেছিল। একটি চারা তালগাছ কোটালের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। ছোট ছোট কচি মোচা বাহির হইয়াছে গাছটির।
কল্কে দাওয়ার উপর রাখিয়া চন্দ্র কহিল, চাচা, তালগাছটা তোমাদের?
আমজাদ মাথা দোলায়।
আহ্ খাসা মোচা বেরিয়েছে। বাঁশগাছ আছে তোমাদের?
কত আছে। দুটো ঝাড়ে পঞ্চাশখানা বাঁশ, সেদিন বাপ গুনছিল।
তা হল বটে–তোমার বাপ বেরসিক। কী মিঠে তাড়ি হয় এই গাছের, চাচা। বাঁশ লাগিয়ে আগডালে উঠে ভাঁড় বাঁধতে যা মজা। কিন্তু তোমার বাপ… হতাশ হইয়া চন্দ্র মাথা দোলাইল।
আমাদের যে তাড়ি খেতে নেই।
গোঁপে তা দিয়া চন্দ্র ঠোঁটে হো শব্দ করে।
বড় হলে খেতে আছে, বাবা। তোমার বাবা একটা আস্ত—
আমজাদ প্রতিবাদ করিল না।
আর একবার কল্কে তুলিয়া লইল চন্দ্র। তারপর এলোপাথাড়ি টান। আমজাদের চোখে ধোঁয়া লাগে। বিরক্ত হইয়া সে চোখ বুজিল।
তোমার বাবা
এই বার চোখ খুলিল আমজাদ।
তোমার বাবা, আজ আর আসবে না।
বিশ্বাস হয় না : আমজাদের।
শিশুসুলভ কণ্ঠে সে বলিল, না, বাপ এবার কোথাও বিদেশে কাজে যাবে না। গাঁয়ে গেছে, এখনই ফিরবে।
চন্দ্র কোটাল শিস দিতে দিতে গুনগুন শব্দ করে। এককালে ভাঁড়-নাচের দলে ছিল। তার প্রহসন-লীলায় হাসির চোটে দর্শকদের নাকি দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হইত।
চন্দ্র গান করে গুনগুন শব্দে।
আমজাদের কৌতূহলের অন্ত নাই। এই লোকটিকে তার ভয়ও লাগে। তবু সে নিঃশব্দে চন্দ্র কোটালের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে লাগিল।
চাচা!
উচ্চকিত আমজাদ জবাব দিল, কী চাচা?
তোমার বাবা ঘরে আছে তো?
হ্যাঁ। ভিনগাঁয়ে যায়নি, বলছি তো বারবার।
তবু একটু অপেক্ষা করি। আর এক কল্কে সেজে আনো।
আমজাদ দ্বিরুক্তি করিল না।
যথাশীঘ্র সে ফিরিয়া আসিল।
উল্লসিত হয় চন্দ্র। আবার পান-সুপারি আনিয়াছে আমজাদ।
দুইজনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আলাপের বিনিময়ে মশগুল।