আলী আজহার খাঁর সাতবছর বয়সের পুত্র আলী আমজাদ খাঁও হারানো বাছুর খুঁজিতে আসিয়া স্তিমিত বৈকালে তারই হানা-রেশ পাঁজরের গলিতটে বারবার যেন শুনিতে পায়।
গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড। এই রাজপথ। শেরশার বিজয় বাহিনীর যাত্রাপথ। পাঠান সম্রাট আর নবাবদের ঐশ্বর্য-দ্রষ্টা ধূলি সড়ক। সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশ আত্মগোপন করিতেছে। পত্রপুষ্পের আবরণে দিনের আলো বাধাপ্রাপ্ত। অন্ধকার অবোধ বালকের মুখেও ছায়া ফেলে। দূরে মলিন আকাশ আর দেখা যায় না। শীতের হিমাচ্ছিন্ন রাত্রির আবাহনী শিরীষের ডালে বাজিয়ে থাকে।
এই রাজপথ বাহিয়া সওয়া-শ বছর আগে আলী মজহার খা পনেরো জন সহচর, আরো কয়েকটা ঘোড়া লইয়া মহেশডাঙার অন্ধকারে আত্মগোপন করিয়াছিলেন। চারিদিকে গাছপালার অরণ্য। ইংরেজ শাসকদের অস্ত্র-বর্ম-সজ্জিত কোনো প্রহরী অন্তত কিছুদিন তাহাদের সন্ধান পাইবে না। বিরাট কর্তব্যের অনুশাসন চতুর্দিকে, মজহার খা বোর শ্লথ করিয়াছিলেন ঘোড়ার। কয়েকদিন কাটিয়া গিয়াছে অশ্বপৃষ্ঠে। শুষ্ক রুটি ও ছোট মশকের পানি মাত্র আহার। বিহারের কাছে কোম্পানির একদল সিপাহী তাহাদের পশ্চাৎ অনুসরণ করিয়াছিল। মজহার খা ভীরু নন। পাঠানের সন্তান বুদিল হয় না কোনোদিন। অনেক সময় আত্মগোপন নিজেকে বিরাটরূপে বিকাশেরই প্রাথমিক উপায় মাত্র। মজহার খাঁ তাই সেদিন পনেরো জন অনুচরসহ বহু জনপদ ও দুর্গম পথে পাড়ি দিয়াছিলেন। বাংলা মুলুকে হয়ত বহুদিন কাটাইতে হইবে। বাংলার মুসলমানের সঙ্গে তাঁর অনেক বুঝাপড়া আছে।
অন্ধকার রাত্রি, শীতের হিম-হাওয়া পথে পথে বাজিয়া যায়। ঘোড়াগুলিকে ঘাস খাইতে দিয়া মজহার খাঁ ও তাঁর সঙ্গীরা রুটি সেঁকিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। প্রতি কার্যে অসম্ভব রকম ক্ষিপ্রতা। আহার সমাপনান্তে মজহার খা একবার ঘোড়র উপর উঠিয়াছিলেন,আবার অবতরণ করিয়াছিলেন তখনই।
মজহার খাঁ বলিয়াছিলেন, ভাইয়ো, ঠৈরকে, মাই আতা। হাঁটু অবধি নাতিদীর্ঘ পাজামা পরিধানে, কোমরে তলোয়ার, বাম বাজুর দিকে গাদা-বন্দুক। মজহার খা মহেশডাঙার অন্ধকারে একাকী ঝাপাইয়া পড়িয়াছিলেন।
সঙ্গী দু-একজন অনুগমন করিতে চাহিল, তিনি বাধা দিলেন। আসহাব, মাই খোদ্ জানে-ওয়ালা।
মহেশডাঙার এইসব অঞ্চল তখন জনবিরল। মুসলমান পরিবার নিতান্ত নগণ্য। আলী মজহার খাঁকে অনিশ্চয়তা বোধ হয়, সেদিন দৈব কিছু সাহায্য করিয়াছিল নচেৎ আকস্মিকভাবে তিনি আরিফউদ্দীন মুনশীর বাড়িতে প্রথমে পৌঁছিয়াছিলেন কিরূপে?
গ্রামে পশ্চিম-দেশীয় ব্যক্তি মাঝে মাঝে আসে। অগাধ রাত্রে মুনশী আরিফউদ্দিন দহলিজে আসিয়া বিস্মিত হইলেন। জনবিরল অঞ্চলে দস্যুর প্রাদুর্ভাব স্বাভাবিক। মুনশী সাহেব নবাব দপ্তরে বহুদিন কাজ করিয়াছেন। পারসি জবানেই মজহার খাঁর পরিচয় গ্রহণ শুরু হইয়াছিল। এক প্রহরের মধ্যে দুই বিদেশী মুসলমানে অন্তরঙ্গতা আরম্ভ হইয়াছিল। একজন যুবক আর একজন বৃদ্ধ। মুনশী সাহেবের যুবক-পুত্র শরিফউদ্দিন পিতার নিকট উপস্থিত হইলেন।
রাত্রির মধ্যে আয়োজন চলিতেছে। কিসের আয়োজন?
মুনশী সাহেব বলিলেন, মেরা এহি এক ল্যাড়াকা। ওয়াস্তে দীন-কে। খোদাকে রাহ্ পর। আহ্বানে কি সেই তৃষ্ণা মিটিয়া গেল? একটি নারীর কাঁকনের কনকন ধ্বনির স্রোতে কি জিন্দানের সহস্র কোটি জিঞ্জিরের আওয়াজ স্তব্ধ করিয়া দিল?
নীড়ের বন্ধন স্বীকার করলেও আলী মজহার খর দিগন্তের পিপাসা কোনোদিন নিবৃত্ত হয় নাই। সে অন্য কাহিনী। ইংরেজ সিপাহীর সঙ্গে আবার তাঁহার মোকাবিলা ঘটে। শহীদি কবরগাহেই তাঁর শেষ সমাধি খোদিত হইয়াছিল।
.
আলী মজহার খাঁর অধঃস্তন পঞ্চম পুরুষ আলী আমজাদ খাঁ বাছুর খুঁজিতে আসিয়া শহীদি কবরগাহের সম্মুখে হঠাৎ দাঁড়াইল। আনমনা সে এই পথে চলিয়া আসিয়াছে।
চারদিকে আগাছা আর খেজুরের জঙ্গল। আলী মজহার খাঁ এইখানে শুইয়া আছেন। তারই পূর্বপুরুষ। রক্তে ছিল যার সিংহের বিক্রম, বুলেটের আঘাতে তাঁর শহীদ রুহ, এইখানে বিশ্রাম লাভ করিতেছে। আলী আমজাদ খাঁ তা জানে না। আলী মজহার খার রুহ কোনোদিন মাগফেরাত প্রার্থী নয়। গিধড় অধঃস্তন বংশধরদের ধিক্কার ও অভিশাপ দেওয়ার জন্য অন্তত তার মাগফেরাতের কোনো প্রয়োজন হইবে না।
.
০১.
প্রহর সন্ধ্যা উত্তীর্ণ।
উঠানের উপরে রান্নাঘর। উপরে কোনো খড়ের ছাউনি নাই। কয়েকটি বাঁশের খুঁটি ও কঞ্চির ছায়ারেখা আগুনের ঝলকে মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। আরো একটি রান্নাঘর আছে উঠানের দক্ষিণে। গ্রীষ্মের দিনে কুঁড়েঘরের ভিতর রান্নার কাজ কষ্টকর। আজহার খাঁ তাই দরিয়াবিবির জন্য উঠানের উপর চালহীন রান্নাঘর তৈরি করিয়াছিল। কয়েকদিন আগেকার ঝড়ে তালপাতা উড়িয়া গিয়াছে। শুধু চালার ফ্রেমটি এখন অবশিষ্ট।
দরিয়াবিবি চুলায় জ্বাল দিতেছিল। হাঁড়ির ভিতর চিড়চিড় শব্দ ওঠে। দমকা বাতাসে আগুনের হলকা বাহির হইয়া আসে। দরিয়াবিবির মুখ দেখা যায়। কপালের চারিপাশ ঘামিয়া উঠিয়াছে।
আমজাদ মার পাশে বসিয়া রান্না দেখিতেছিল। অন্যদিকে খড় কুঁচকাইতেছিল আজহার খাঁ।
আমজাদ।
কি আব্বা?
এক আঁটি খড় বঁটির মুখে রাখিয়া আজহার একবার কপালের ঘাম মুছিবার চেষ্টা করিল।
অনেক দূর খুঁজেছি, আব্বা। ভারি বজ্জাত। গাইও তেমনি। বাছুর হারায়।