বংশের ইজ্জত!
আপ্ত রমণীর মতো দরিয়াবিবি সেদিন গর্জন করিয়াছিল।
ইহাদের মুখে চুনকালি দেওয়ার আর কোনো পথ সে অনাবিষ্কৃত রাখিবে না। পাঁচ মাস পরে বিপত্নীক আজহার খাঁকে নেকাহ্ করিল দরিয়াবিবি।
চোখ বুজিয়া নিস্তার নাই। দরিয়াবিবির সম্মুখে অতীতের বিষধর ফণা চক্র দোলাইয়া কুটি ছড়াইয়া যায়। কত মুখ ভাসিয়া আসে– জবেদ হোসেন-আহাদ হোসেন মোনাদির।…মোনাদিরের কপালে একটা কালো দাগ ছিল জন্মাবধি। গৌর চেহারায় জ্বর উপরে গোল দাগ… চুম্বনে চুম্বনে মুছিয়া গিয়াছে কি দাগ? এখনও শ্মশান পাহারায় রত চণ্ডালের অট্টহাসের মতো অন্ধকারে ঝন্ঝনা বাজিয়া যায়।
নঈমার কচি মুখের উপর দরিয়াবিবি তার অশ্রুসিক্ত ঠোঠ চাপিয়া ধরিল। জ্বালা ধরে দুই চোখে। নিরবচ্ছিন্ন বিস্মরণ-পিপাসু পীড়িত হৃদয়-কোণ মমতাময়ী শিয়রে জাগিয়া দাঁড়াক একবার। দরিয়াবিবি তারই প্রতীক্ষা করে!
.
০৫.
কয়েকদিন পরে দরিয়াবিবি আসেকজানের ঘরে ঢুকিয়া দেখিল বুড়ি চুপচাপ বসিয়া আছে, জাকাতের পাওয়া কাপড় দুটি নাড়াচাড়া করিতেছে। নিঃশব্দে আসিয়াছিল দরিয়াবিবি। বুড়ি কিছুই টের পাইল না।
খালা ডাক শুনিয়া সে নিজের আঁচলের ভেতর কাপড় দুটি ত্রস্ত তুলিয়া লইল, যেন চুরি করিতে গিয়া ধরা পড়িয়াছে।
কোনো জবাব দেওয়ার পূর্বেই দরিয়াবিবি বলিল : খালা, রাগ করো না। একটা কাপড় আমাকে দাও। পরে দাম দিয়ে দেব।
বৃদ্ধাকে নিছক সন্তুষ্ট করিবার পন্থা মাত্র। দরিয়াবিবি নিজেও জানে, ছয় মাসের পূর্বে আর সে দাম চুকাইয়া দিতে সক্ষম হইবে না।
ফোগলা দাঁতে হাসি ফোটে। আসেকজান শশব্যস্ত কাপড় দুটি বাহির করিল।
যেটা ভালো, সেটা বেছে নাও, মা। দেখো দিকি, কোন্টার জমিন বেশ ভালো।
মাদুরের উপর বসিয়া পড়িল দরিয়াবিবি।
খালা, তোমার শরীর ভালো তো?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে আসেকজান।
না, মা। দুদিন থেকে বড় মাথা ধরেছে। চোখ ধোঁয়া ধোঁয়া।
অনুতপ্ত হয় দরিয়াবিবি। ইহা তারই নিষ্ঠুরতার পরিণতি, তা উপলব্ধি করিয়া বড় ব্যথিত হয়।
তুমি বাইরে চলো, ঠাণ্ডা পানিতে মাথাটা ধুইয়ে দিই। আজ আর কোথাও বেরিয়ো না।
ও পাড়ায় দাওয়াৎ ছিল। দুপুরে যাব কষ্ট করে।
কিসের দাওয়াৎ?
জলিল শেখের ওখানে। আজ ওর ছেলের চল্লিশে কিনা।
দরিয়াবিবি জানে, জলিল শেখের রোজগারী জওয়ান ছেলে কিছুদিন আগে ম্যালেরিয়া জ্বরে ভুগিয়া ইন্তেকাল করিয়াছে। তার মুখটি মনে পড়িয়া গেল দরিয়াবিবির। বলিল, আহা!
অনেক লোক খাওয়াবে। আমজাদকে সঙ্গে নিয়ে যাব?
কে যেন বিছুটি চালায় দরিয়াবিবির সর্বাঙ্গে।
আজ কিন্তু ক্রোধের কোনো চিহ্ন নাই তার মুখে।
শান্ত কণ্ঠেই সে বলে, না খালা, তার গিয়ে কাজ নেই। তুমিও আজ কোথাও যেয়ো। এখানেই খাবে।
আসেকজান প্রায়ই গাঁ হইতে এইরূপ দাওয়াৎ পায়। ধনীদের বাড়িতে চর্ব-চোষ্যের বহু আয়োজন হয়। আসেকজান শুধু নিজের উদরপূর্তি করিয়া আসে না। অনেক সময় নানা খাবার সঙ্গে আনে। অন্ধকার ঘরে তার অংশগ্রহণ করে আমজাদ অথবা নঈমা। দরিয়াবিবির চোখে কয়েকবার ধরা পড়িয়াছে তারা। আসেকজানও তার জন্য তিরস্কার ভোগ করে।
পরলোকগত ব্যক্তির চল্লিশার খাবার সঙ্গে করিয়া আনিতে আসেকজানের কোনো দ্বিধা নাই। দরিয়াবিবি ছেলেদের অমঙ্গল চারিদিকে যেন দেখিতে পায়। খুব সাবধানী সে। আজ ঝগড়ার কোন সূত্রপাত দেখা গেল না।
দরিয়াবিবি শুধু অনুরোধ করিল মাত্র : আজ কোথাও যেয়ো না, খালা।
জলিল শেখ পাটের ব্যাপারী। নৌকা আছে তিন-চারখানা। বেশ অবস্থাপন্ন ঘর। সেখানকার আয়োজন কল্পনাই করা চলে। আসেকজানের লোভ হয় খুব। কিন্তু দরিয়াকে সে ভয় করে। চুপ করিয়া গেল সহজে। তার কল্পনা-নেত্র কিন্তু তারপর তৃষিত হইয়া উঠিতেছিল।
কাপড় দুটি দরিয়াবিবি আধ-অন্ধকারে বারবার তুলনা করিয়া বলিল, এই লাল সরু পাড়টা নিলাম, খালা।
বেশ, বেশ! আমার কি আর এসব মানায়, মা! শাদা কাফন পরে কবরে যেতে পারলেই ভালো।
বাজে কথা কেন মুখে, খালা? এই সকালে আর কোনো কথা মুখে আসে না বুঝি। চলো বাইরে। মাথাটা ধুইয়ে দিই।
দুইজনে দাওয়ায় আসিয়া পৌঁছিল।
দরিয়াবিবি এক বদনা পানি লইয়া বৃদ্ধার শণের মতো শাদা চুলের উপর ঢালিতে লাগিল।
চুপচাপ বসো। আরো তিন-চার বদনা ঢালতে হবে।
বসছি, মা। একটু তেল দিয়ে দিস বউ।
দরিয়াবিবি চুলের ভিতর আঙুল চালাইয়া বদনার নল দিয়া ধীরে ধীরে পানি চোয়াইতে ব্যস্ত।
আসেকজানের শরীর ভারমুক্ত হইতেছে। আহ্ শব্দে তার আনন্দ ধরা পড়ে। নারিকেল তেল আনিল দরিয়াবিবি। চুলের গুছির ভেতর বেশ চুকচুকে করিয়া দিতে লাগিল।
খালা, দশ ঝন্ঝাটে শরীরটা জ্বলে গেল। মেজাজ ঠিক থাকে? কখন যে কাকে কী বলি–হদিশ থাকে না।
মা, জানটা আসান হলে। আল্লার দোয়া লাগুক তোমার শরীরে।
তেল দেওয়ার অজুহাতে দরিয়াবিবি আসেকজানের মাথাও টিপিয়া দিল খানিকক্ষণ। কোরা কাপড়খানা একটি চটির উপর পড়িয়াছিল, দরিয়াবিবির চোখ সেদিকে বারবার আকৃষ্ট হইতে ছিল।
রান্না চড়িয়েছ বউ?
সে আর বাকি আছে, মা? আমুর পেট খারাপ। আজ পান্তা খেতে দিইনি। মতব থেকে এসে একবার ভাত খাবে।
এমন সময় আমজাদের গলা শোনা গেল। ভিটের নিচে হইতে সে চিৎকার করিতেছে মা-মা-।
দরিয়াবিবি উৎকর্ণ হয়। না, এক পা বাড়ানোর পূর্বেই স্বয়ং আমজাদকে উঠানে দেখা গেল।